আগের অধ্যায়ে আমরা ভারতের চিরাচরিত অর্থনীতিতে ভাঙন ( The Decline of the Traditional Indian Economy ) নিয়ে আলোচনা করেছি। এই অধ্যায়ে আমরা ভারতীয় বস্ত্রশিল্পের অবক্ষয় [ Decline of the Indian Cotton Industry ] নিয়ে আলোচনা করব।
সুতিবস্ত্রে ভারতের খ্যাতি :
সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতকে ভারতের প্রধান শিল্প ছিল বয়নশিল্প। বারাণসী, লক্ষ্ণৌ, আগ্রা, মুলতান, লাহোর, বুরহানপুর, সুরাট, ব্রোচ, আমেদাবাদ, বাঙ্গালোর, মাদুরাই, বিশাখাপত্তনম ও মাদুরা ছিল সুতিবস্ত্রের বিখ্যাত কেন্দ্র। বারাণসী ও আমেদাবাদের কিংখাব, পুণা ও সন্নিহিত অঞ্চলের রঙিন তাঁতের কাপড়, কাশ্মীর ও পাঞ্জাবের পশমের শালের চাহিদা বিদেশের বাজারে ছিল ব্যাপক। তবে এ সবের ওপরে ছিল বাংলার সুতি ও রেশম বস্ত্রের চাহিদা। বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের উৎকৃষ্ট মানের সুতি ও রেশম বস্ত্র তৈরি হত। মসলিন ও সুতিবস্ত্রে ঢাকা ছিল জগৎ-বিখ্যাত। এছাড়া বাংলার নাটোর, ক্ষীরপাই, রাধানগর, ঘোড়াঘাট, দেওয়ানগঞ্জ, শাস্তিপুর, কৃষ্ণনগর, ফরাসডাঙ্গা প্রভৃতি স্থানও যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছিল। গুণগত মান অতি উন্নত হওয়ায় বিদেশের বাজারে এইসব বস্ত্রাদির চাহিদা ছিল ব্যাপক। রবার্ট ওরমে লিখেছেন যে, বাংলার প্রতিটি গ্রামের পুরুষ, নারী ও শিশুরা বস্ত্রবয়নে নিযুক্ত থাকত। উইলিয়ম বোল্টস্ লিখছেন যে, নবাবী আমলে বাংলার তাঁতীরা স্বাধীনভাবে নিজেদের মূলধনে বস্ত্র তৈরি করত এবং প্রতিযোগিতামূলক বাজারে নিজেদের পছন্দমতো দামে বিক্রি করত। হেনরী পান্ডুলো লিখছেন যে, বস্ত্রশিল্পে পৃথিবীর আর কোন দেশ বাংলার সমকক্ষ হতে পারবে না বা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বাংলাকে হারাতে না। ইওরোপীয় বণিকরা বাংলা তথা ভারতের এইসব সুতি ও মসলিন বস্ত্রাদি ইওরোপের বাজারে বিক্রি করে প্রচুর মুনাফা লুঠত।
ইংল্যান্ডে ভারতীয় সুতিবস্ত্রের জনপ্রিয়তা :
ইংল্যান্ড ও ইওরোপের প্রায় প্রতিটি দেশে ভারতের সুতি ও রেশম বস্ত্র প্রভূত জনপ্রিয়তা অর্জন করে। ব্রিটেনের নারীদের কাছে ভারতীয় রঙিন সুতিবস্ত্রের যথেষ্ট চাহিদা হয়। গৃহসজ্জার জন্য তাঁরা বিভিন্ন রঙের ভারতীয় পর্দা ব্যবহার করতে থাকেন। ভারতীয় বস্ত্রাদির এই জনপ্রিয়তার জন্য একসময় ইংল্যান্ড এইসব পণ্যাদির ওপর আমদানি শুল্ক হ্রাস করে। এর ফলে ইংল্যান্ডে এর রপ্তানি যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়। ‘রবিনসন ক্রুসো’ নামক গ্রন্থের বিখ্যাত লেখক ডেফো দুঃখ করে লেখেন যে, ইংল্যান্ডের ঘরে ঘরে, বসবার ঘর ও শোবার ঘর—সর্বত্রই ভারতীয় বস্তু ঢুকে পড়েছে।
ইংল্যান্ডে ভারতীয় সুতিবস্ত্রের ওপর আঘাত :
ভারতীয় বস্ত্রশিল্পের এই জনপ্রিয়তা ইংল্যান্ড ও ইওরোপের বস্ত্র-উৎপাদনকারীরা সুনজরে দেখেনি। এর ফলে ইংল্যান্ড-সহ ইওরোপের বিভিন্ন দেশের কলকারখানায় মন্দা দেখা দেয়। শ্রমিক ছাঁটাই হতে থাকে এবং তাঁতীরা বেকার হয়ে পড়ে। ইওরোপের বিভিন্ন দেশের শিল্পপতিরা। ভারতীয় সুতি ও রেশমী বস্ত্র আমদানির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে এবং সংরক্ষণ নীতি গ্রহণের দাবি জানাতে থাকে। শিল্পপতিদের চাপে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ১৭০০ খ্রিস্টাব্দে এক আইন পাস করে ইংল্যান্ডে বাংলা, পারস্য ও চীনের রেশম বস্ত্র ব্যবহার নিষিদ্ধ করে। ১৭২০ খ্রিস্টাব্দের এক আইনে ভারত থেকে রঙিন সুতিবস্ত্র আমদানি নিষিদ্ধ হয়। ১৭৪৭, ১৭৫৯ এবং ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডে আমদানিকৃত সুতিবস্ত্রের ওপর উচ্চহারে শুল্ক আরোপ করা হয়। ইংল্যান্ডের বাইরে ইওরোপের অন্যান্য দেশেও এই অবস্থা চলতে থাকে। এতেও কিন্তু ভারতীয় বস্ত্রের চাহিদা বিন্দুমাত্র হ্রাস করা সম্ভব হয়নি।
অন্যান্য বণিকরা বিতারিত :
১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধের পর অবস্থার পরিবর্তন ঘটে। কোম্পানী তার রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে অন্য ভারতীয় ও পাইকারি ক্রেতাদের বাংলা থেকে বিতাড়িত করে। আগে উত্তর ভারত থেকে বহু পাইকারি ক্রেতা বাংলার কাপড় কিনতে আসত। কোম্পানীর বিধি-নিষেধের ফলে তারা বাংলায় আসা বন্ধ করে। ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দের পর অন্যান্য ইওরোপীয় কোম্পানীগুলি বাংলা থেকে সরে যেতে বাধ্য হয়। এইভাবে বাংলার বাণিজো কোম্পানীর একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
দাদন প্রথা :
উইলিয়ম বোল্টস্-এর রচনা থেকে জানা যায় যে, কোম্পানীর দালালরা তাতীদের ভয় দেখিয়ে একমাত্র তাদের জন্যই সুতিবদ্ধ বুনতে বাধ্য করাত এবং এজন্য তারা জোর করে তাঁতীদের দাদন বা অগ্রিম নিতে বাধ্য করত। দাদন বা অগ্রিম নেওয়া তাঁতী বাজারদরের চেয়ে শতকরা ২০ থেকে ৪০ ভাগ কম মূল্যে লোকসান স্বীকার করে তার বস্ত্র কোম্পানীকে বিক্রি করতে বাধ্য থাকত। দাদন গ্রহণের পর তাঁতী অন্য কোন কোম্পানী বা ক্রেতার কাছে বস্ত্র বিক্রি করতে পারত না বা তাদের জন্য বস্ত্র তৈরি করতে পারত না। এইভাবে কোম্পানী দেশী-বিদেশী দু’ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বীকেই বাজার থেকে সরিয়ে দেয় । উইলিয়ম বোল্টস্ লিখছেন যে, তাঁতীদের যে-ভাবে ঠকানো হচ্ছে তা কল্পনার অতীত।
কমিশন :
কোম্পানীর গোমস্তা, দালাল, পাইকার, জাহনদার, তাগাদার তাঁতীদের কাছ থেকে দপ্তরি, দালালি, বাট্টা প্রভৃতি বিভিন্ন খাতে কমিশন আদায় করত। কোম্পানীর উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা সকলেই এই কমিশনের ভাগ নিতেন, এবং এই কারণেই এই অন্যায় প্রথা তুলে দেওয়া সম্ভব হয়নি। কোম্পানীর কর্মচারীরা উঁচুমানের কাপড়ের নিচুমান ধার্য করে তাঁতীদের ফাঁকি দিত এবং নিজেরা লাভবান হত।
তুলোর একচেটিয়া কারবার :
কোম্পানী কাঁচা তুলোর ব্যবসা একচেটিয়াভাবে নিজেদের হাতে রেখে দেয়। তাঁতীরা আগে দক্ষিণ ভারত থেকে তুলো আমদানি করত, কিন্তু কোম্পানী পরে নিজেই সেই তুলোর সবটা কিনে নিয়ে মণ প্রতি ১৪/১৫ টাকা বেশি দামে তাঁতীদের তা কিনতে বাধ্য করে। এর ফলে তাঁতী বেশি দামে তুলো কিনে কম দামে বস্ত্র বিক্রি করতে বাধ্য হয়। কেনা ও বেচা দু দিকেই তাকে ক্ষতি স্বীকার করতে হয়। এইসব অনাচার তাঁতীরা কিন্তু সর্বদা মুখ বুজে সহ্য করেনি। ১৭৭৫ খ্রিস্টাব্দে সোনারগাঁর তাঁতীরা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। শান্তিপুরের তাঁতীরা প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠলে তাদের নেতাদের বন্দী করা হয়।
প্রাকৃতিক বিপর্যয় :
ছিয়াত্তরের মন্বন্তর যে বাংলার সুতিবস্ত্র শিল্পের ওপর প্রচণ্ড আঘাত হেনেছিল, সে সম্পর্কে সন্দেহ নেই। দুর্ভিক্ষের ফলে প্রায় অর্ধেক শ্রমিক কারিগরের মৃত্যু হয় এবং এর ফলে আর তাঁত শিল্পের পুনরুস্থান সম্ভব হয়নি। ড. হামিদা হোসেন তাঁর ‘The Company Weavers ‘of Bengal’ গ্রন্থে দেখিয়েছেন যে, এ ধরনের আরও প্রাকৃতিক দুর্যোগ বাংলার তাঁত শিল্পের ওপর আঘাত হানে। তিনি জানান যে, ১৭৮৭-৮৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলার পূর্ব ও দক্ষিণ অঞ্চল যে ভয়াবহ বন্যা ও ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে তার প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সিলেট, রংপুর, বীরভূম, নদীয়া, মালদহ, চট্টগ্রাম প্রভৃতি এলাকার গরিব চাষী ও তাঁতশিল্পের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা।
দেশীয় রাজ্যগুলির পতন :
ইংরেজের আগ্রাসী নীতির ফলে দেশীয় রাজ্যগুলির পতন এবং প্রাচীন অভিজাত সম্প্রদায়ের অবলুপ্তির ফলে ভারতীয় হস্তশিল্প ধ্বংস হয়। দেশীয় রাজন্যবর্গ দেশীয় শিল্পের পৃষ্ঠপোষক ও খরিদ্দার ছিলেন। এই রাজ্যগুলির অবলুপ্তির ফলে দেশীয় শিল্প ও কারিগর সম্প্রদায় ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়।
শিল্প বিপ্লব :
ইতিমধ্যে ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে। ইংল্যান্ডের কলকারখানায় ব্যাপক হারে সুতিবস্ত্রউৎপাদিত হতে থাকে। ইংল্যান্ডের শিল্পপতিরা সরকারের ওপর চাপ দিতে থাকে, যাতে উঁচু মানের ও সস্তা দামের ভারতীয় বস্ত্র ইংল্যান্ডে প্রবেশ করতে না পারে। ১৭৫৯ ও ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের পার্লামেন্ট ভারতীয় সুতিবস্ত্রের ওপর ৪৫% শুল্ক আরোপ করে। একটি বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে ভারত থেকে আমদানি করা একটি রঙিন রুমাল ব্যবহারের জন্য এক ইংরেজ মহিলাকে ২০০ পাউন্ড জরিমানা দিতে হয়। এইভাবে ইংল্যান্ডের বাজার থেকে ভারতীয় সুতিবস্ত্র বিদায় নিতে শুরু করে।
ভারতে ব্রিটিশ বস্ত্রাদি :
এরপর ইংল্যান্ডের মিল মালিকরা ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর একচেটিয়া বাণিজ্যাধিকারের অবসান ঘটিয়ে তাদের মিলে তৈরি বস্ত্রাদি ভারতে পাঠাবার দাবি করতে থাকে। ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে ভারতের দরজা ব্রিটিশ কোম্পানীগুলির জন্য ঈষৎ খুলে দেওয়া হল। এর ফলে সস্তা দরের বিলাতি বস্ত্রের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় হেরে গিয়ে ভারতীয় তাতীরা পিছু হঠতে শুরু করে। ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ড থেকে ভারতে আসে ১৫৬ পাউন্ড মূল্যের বিলাতি বসু। ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে তার পরিমাণ হয় ১ লক্ষ ১০ হাজার পাউন্ড। এভাবে ভারতে ব্রিটিশ পণ্যের অনুপ্রবেশ ঘটতে থাকলে ভারতীয় বস্ত্রশিল্পের অবস্থা সঙ্গিন হয়ে ওঠে।
১৭৯৩-এ ইংল্যান্ড ফ্রান্সের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ১৮০৬ খ্রিস্টাব্দে নেপোলিয়ন মহাদেশীয় অবরোধ ঘোষণা করলে ইওরোপের বাজারে ব্রিটিশ পণ্যের প্রবেশ নিষিদ্ধ হয় এবং বাংলার বস্ত্রশিল্পেও মন্দা দেখা দেয়।
অবাধ বানিজ্য :
১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে ভারতে কোম্পানীর একচেটিয়া ব্যবসা অবলুপ্ত হলে বিলাতি বস্ত্র জলের মতো অবাধ বাণিজ্য ভারতে ঢুকতে থাকে। সুতিবস্ত্রের রপ্তানি বন্ধ হওয়ায় বাংলার জাতীয় শিল্প তাঁত প্রায় ধ্বংসের মুখে এসে দাঁড়ায়। ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে ভারতে কোম্পানীর বাণিজ্যাধিকার লোপ পেলে তাঁতশিল্পের সর্বনাশ চূড়ান্ত হয়।
শুল্ক আরোপ :
ঔপনিবেশিক শাসনের স্বাভাবিক নিয়মানুসারে ইংল্যান্ড-জাত দ্রব্যগুলি বিনাশুল্কে ভারতে আসতে থাকে এবং অপরদিকে ভারতীয় পণ্যাদি—বিশেষত সুতিবস্ত্রের ওপর চাপানো হয় বিরাট করের বোঝা। এই অসম প্রতিযোগিতায় ভারতীয় সুতিবস্ত্র পিছু হঠতে থাকে। ১৭৯৭-এ ভারতীয় ‘ক্যালিকো’ বস্ত্রের ওপর ইংল্যান্ডে আমদানি গুপ্তের হার ছিল ১৮%। ১৮২৪-এ তা হল ৬৭১/২%। মসলিনের ওপর আরোপিত হল ৩৭১/,% শুল্ক। ইংরেজ ঐতিহাসিক উইলসন (H. H. Wilson) লিখেছেন যে, ভারতের সঙ্গে সুতিবস্ত্র বাণিজ্যের ইতিহাস হল। ভারতের প্রতি অন্যায় আচরণের বিষাদময় ইতিহাস। তাঁর মতে ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ভারতের সুতি ও রেশম বস্ত্রাদি ইংল্যান্ডে তৈরি মালের চেয়ে শতকরা ৫০ থেকে ৬০ ভাগ কম দামে ইংল্যান্ডের। বাজারে বিক্রি করেও যথেষ্ট লাভ করা যেত। এই প্রতিযোগিতার হাত থেকে ব্রিটিশ বস্ত্রশিল্পকে বাঁচাবার জন্য ভারতে উৎপন্ন বস্ত্রের ওপর শতকরা সত্তর থেকে আশিভাগ শুল্ক ধার্য করা হয়। যদি বিভিন্ন কঠোর আইন দ্বারা ভারতীয় বস্ত্রের ব্রিটেনে প্রবেশ রুদ্ধ না করা হত, তাহলে ম্যাঞ্চেস্টার ও পেইসল- এর বস্ত্র-কারখানাগুলি শুরুতেই বন্ধ হয়ে যেত। তখন যদি ভারত স্বাধীন দেশ হত তাহলে এই অন্যায়ের হাত থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারত। ১৮৩৪ খ্রিস্টাব্দে লর্ড বেন্টিঙ্ক বলেন যে, ভারতীয়রা যে গভীর দুর্দশায় পড়েছে বাণিজ্যের ইতিহাসে তার তুলনা মেলা ভার। সুতিবস্ত্র-শিল্পীদের অস্থি ভারতের মাটিকে সাদা করে তুলেছে।
ফলাফল :
বেকারত্ব :
ভারতীয় বস্ত্রশিল্পের ধ্বংস ভারতের আর্থ-সামাজিক জীবনে ব্যাপক পরিবর্তনের সূচনা করে। (১) ইংল্যান্ডে তাঁতশিল্পের ধ্বংসের সঙ্গে সঙ্গে সেখানে কলকারখানা গড়ে ওঠে। এর ফলে তাঁতশিল্পের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা কলকারখানায় কাজ পায়। ভারতে কিন্তু এ ধরনের কোন কলকারখানা গড়ে ওঠেনি। এর ফলে তাঁতী এবং তাঁতশিল্পের সঙ্গে যুক্ত বহু মানুষ–তুলোচাৰী, মুতাকাটুনী, হাতের কাজের শিল্পী ও অন্যান্য কারিগর — সকলেই বেকার হয়ে পড়ে। ড. নরেন্দ্রকৃষ্ণ সিংহের মতে ১৮২৮ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ বাংলার অন্তত ১০ লক্ষ লোক বয়নশিল্প থেকে কর্মচ্যুত হয়। এদের অধিকাংশই কৃষিকর্মে নিযুক্ত হলেও, অনেকেই সন্ন্যাসী ও বৈরাগীর দলে নাম লেখায় এবং অনেকে নিছক ভিক্ষুকে পরিণত হয়। অনেকে আবার খাদ্যের অভাবে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। মুর্শিদাবাদে অবস্থানকারী কোম্পানীর রেসিডেন্ট মি. বেচার ১৭৮৭ খ্রিস্টাব্দে মন্তব্য করেন যে, “ইতিপূর্বে বাংলা ছিল জাতিসমূহের শস্যাগার এবং প্রাচ্যের বাণিজ্য, শিল্পকর্ম ও সম্পদের ভাণ্ডার। কিন্তু আমাদের অপশাসনের ফলে কুড়ি বছরের মধ্যে দেশের বহু অংশ প্রায় মরুভূমির রূপ পরিগ্রহ করেছে।”
কৃষির ওপর চাপ :
(২) এতদিন কৃষি ও শিল্প ছিল ভারতীয় অর্থনীতির ভিত্তি এবং এই দুইয়ের যৌথ মিলনে ভারতীয় অর্থনীতি গড়ে উঠেছিল। এদেশের লক্ষ লক্ষ কৃষক কৃষি এবং আংশিকভাবে কুটির শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থেকে জীবনযাত্রা নির্বাহ করত। ইংরেজদের অর্থনৈতিক নীতির ফলে হস্তশিল্প ধ্বংস হয় এবং কৃষক ও কারিগর সকলেই সম্পূর্ণভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এর ফলে কৃষির ওপর প্রবল চাপ পড়ে এবং কৃষির সুষ্ঠু অগ্রগতি ব্যাহত হয়। রজনী পাম দত্ত ইন্ডিয়া টু-ডে’ গ্রন্থে বলেন যে, ইংরেজদের চাপে ভারতে কৃষি ও শিল্পের যুগ্ম অস্তিত্ব বিপন্ন হয়। ভারত পরিণত হয় ইংল্যান্ডের কৃষিজ উপনিবেশে।
শহরের অবনতি :
(৩) বস্ত্রশিল্পের পতনের ফলে এই শিল্পকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা শহরগুলি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে ক্লাইভ মুর্শিদাবাদকে লন্ডনের সঙ্গে তুলনা করেন, কিন্তু ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ মুর্শিদাবাদ এক জনবিরল গ্রামে পরিণত হয়। ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে ঢাকার জনসংখ্যা ছিল প্রায় দেড় লক্ষ। ১৮৩০-এ ঢাকা একটি শ্রীহীন নগরীতে পরিণত হয় এবং এর জনসংখ্যা প্রায় অর্ধেকে নেমে আসে। ১৭৯০-এ ঢাকায় সুতিবস্ত্রে ২৫ লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করা হয়। ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে এর পরিমাণ দাঁড়ায় মাত্র ২ লক্ষ টাকা।
বিত্তহীন শ্রমিক :
(8) বস্ত্রশিল্পের সঙ্গে যুক্ত কারিগর ও সাধারণ কর্মীদের একটি অংশ কৃষিকার্যের দিকে ঝুঁকলেওএক বিশাল সংখ্যক মানুষ ভাড়াটে মজুর বা কৃষি শ্রমিকে পরিণত হয়। এইভাবে ভারতে বিত্তহীন শ্রমিক বা ‘প্রলেটারিয়েট’ শ্রেণীর উদ্ভব হয়।