ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তার | Spread of Western Education

 আগের অধ্যায়ে আমরা ভারতীয় বস্ত্রশিল্পের অবক্ষয় [ Decline of the Indian Cotton Industry] নিয়ে আলোচনা করেছি। এই অধ্যায়ে আমরা ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তার [ Spread of Western Education ] নিয়ে আলোচনা করব।


বাণিজ্যিক স্বার্থে এদেশে এসে একটি ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থা স্থাপন করলেও ইংরেজদের সংস্পর্শে আসার ফলে ভারত ইতিহাসে এক নবযুগের সূত্রপাত হয়। পাশ্চাত্য সভ্যতা জরাজীর্ণ ভারতীয় সভ্যতা ও সমাজ জীবনের ওপর এক চরম আঘাত হানে। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সভ্যতার সংঘর্ষে যে নব-ভারত গড়ে ওঠে তার মূলে ছিল পাশ্চাত্য শিক্ষা।

দেশের প্রচলিত শিক্ষা :

ইংরেজ শাসনের সূচনা পর্বে হিন্দু-মুসলিম ভারতবাসী পাঠশালা, টোল, মক্তব ও মাদ্রাসায় আরবী, ফার্সী ও সংস্কৃত-র মাধ্যমে শিক্ষা লাভ করত। পাঠশালা ও মক্তবের শিক্ষা সাধারণ কিছু প্রাথমিক জ্ঞান ও ধর্মীয় উপাখ্যান পাঠের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। ওয়ার্ড-এর বিবরণ থেকে জানা যায় যে, ১৮০৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলার প্রায় প্রতি গ্রামে পাঠশালা ছিল। ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে উইলিয়ম অ্যাডামের প্রতিবেদনে বাংলা প্রদেশে প্রায় এক লক্ষ পাঠশালার অস্তিত্বের কথা জানা যায়। তিনি আরও বলেন যে, আঞ্চলিক প্রভেদ থাকা সত্ত্বেও সমগ্র ভারতে মোটামুটি একই ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। টোল ও মাদ্রাসা ছিল উচ্চ শিক্ষাকেন্দ্র এবং সেখানে সংস্কৃত ও আরবী-ফার্সীর মাধ্যমে শাস্ত্রগ্রন্থের চর্চা হত। নবদ্বীপ, মিথিলা, বারাণসী, বিক্রমপুর প্রভৃতি স্থানের টোলগুলি ছিল সংস্কৃত চর্চার উল্লেখযোগ্য কেন্দ্র। পাটনা, মুর্শিদাবাদ, দিল্লী, লাহোর প্রভৃতি স্থানের মাদ্রাসাগুলি আরবী-ফার্সী চর্চার কেন্দ্র হিসেবে উল্লেখযোগ্য ছিল। উইলিয়ম অ্যাডামের প্রতিবেদন থেকে বাংলা প্রদেশে এ ধরনের প্রায় ১৮০০ টোলের কথা জানা যায়। বলা বাহুল্য, শিক্ষার অবস্থা সেদিন এমনই শোচনীয় ছিল যে, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল, গণিত, প্রকৃতি- বিজ্ঞান প্রভৃতি সম্পর্কে মানুষের কোন ধারণাই ছিল না।

সরকারি মনোভাব :

ইংরেজ শাসনের সূচনা পর্বে কোম্পানী ভারতে ইংরেজী শিক্ষা বিস্তারের বিরোধী ছিল। কোম্পানী মনে করত যে, ইংরেজী শিক্ষা পেলে ভারতবাসীর মনে স্বাধীনতা স্পৃহা বৃদ্ধি পাবে এবং হয়তো ভারত কোম্পানীর হস্তচ্যুত হয়ে যাবে। এই কারণে কোম্পানী ভারতে সংস্কৃত ও আরবী-ফার্সী শিক্ষাতেই উৎসাহ দিত। এই মর্মে বড়লাট হেস্টিংস আরবী- ফার্সী ও মুসলিম আইনচর্চার উদ্দেশ্যে ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে ‘কলকাতা মাদ্রাসা’ প্রতিষ্ঠা করেন। কলকাতা সুপ্রীম কোর্টের অন্যতম বিচারপতি স্যার উইলিয়ম জোন্স-এর উদ্যোগে প্রাচ্যবিদ্যা চর্চার উদ্দেশ্যে * ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ‘এশিয়াটিক সোসাইটি’ স্থাপিত হয়। বারাণসীর ইংরেজ রেসিডেন্ট জোনাথন ডানকান সংস্কৃত শিক্ষার উন্নতির জন্য ‘বারাণসী সংস্কৃত কলেজ’ (১৭৯২ খ্রিঃ) প্রতিষ্ঠা করেন। এসময় ভারতে কর্মরত উচ্চপদস্থ ইংরেজ কর্মচারীদের ভারতীয় ভাষা, আইন, সংস্কৃতি ও রীতিনীতি শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে বড়লাট লর্ড ওয়েলেসলি ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় ‘ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ” স্থাপন করেন। বাংলা সাহিত্যের বিকাশে এই কলেজের কৃতী অধ্যাপকদের ভূমিকা খুবই উল্লেখযোগ্য ছিল। এইসব প্রতিষ্ঠান থেকে শিক্ষানীতি সম্পর্কে শাসকদের মনোভাবের পরিচয় পাওয়া যায়।

পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রচলন :

চার্লস গ্রান্ট নামে কোম্পানীর এক অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারী এদেশে সর্বপ্রথম একটি সুসংবদ্ধ শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের দাবি জানান। ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দে লিখিত এক পুস্তিকায় (‘Observation’) তিনি ভারতীয় সমাজ, ধর্ম ও চরিত্রের তীব্র নিন্দা করে বলেন যে, ইংরেজী শিক্ষা বিস্তৃত হলেই ভারতীয়দের পচনশীল সমাজ ও অধঃপতিত নৈতিকতা উন্নত হবে। বলা বাহুল্য, কোম্পানী সেদিন তাঁর কথায় কর্ণপাত করেনি, কিন্তু ইংরেজী শিক্ষার চাবিকে আর বেশি দিন উপেক্ষা করা সম্ভব হল না। ইংরেজ রাজত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এদেশে ইংরেজদের আইন-আদালত প্রতিষ্ঠিত হতে লাগল। ইংরেজ বণিকরাও নানা স্থানে তাদের বাণিজ্যাগার স্থাপন করতে লাগল। তাদের অধীনে কর্মরত ভারতীয়দের ইংরেজী জ্ঞানের প্রয়োজন ছিল। মধ্যবিত্ত বাঙালী চাকরি লাভের আশায় ইংরেজী শিক্ষার প্রতি আকর্ষণ বোধ করতে লাগল। এই সুযোগে কয়েকজন বিদেশী কলকাতায় ইংরেজী শিক্ষার বিদ্যালয় খুলে বসল। এগুলির মধ্যে শোরবোর্ন, মার্টিন, বাউল, আরটুন পিট্রাস, ডেভিড ড্রামন্ড পরিচালিত বিদ্যালয়গুলি উল্লেখযোগ্য। এখানে উল্লেখ্য যে, প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, রামগোপাল ঘোষ প্রমুখ নেতৃমণ্ডলী শোরবোর্ন পরিচালিত বিদ্যালয় এবং ‘ইয়ং বেঙ্গল’ আন্দোলনের প্রবর্তক হেনরী ডিরোজিও ডেভিড ড্রামন্ড পরিচালিত বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন।

খ্রিস্টান মিশনারিদের অবদান :

ইংরেজী শিক্ষা বিস্তারের ইতিহাসে খ্রিস্টান মিশনারিদের ভূমিকা অতি গুরুত্বপূর্ণ। খ্রিস্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে তাঁরা ভারতের নানা অঞ্চলে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে থাকেন। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে মার্শম্যান, ওয়ার্ড ও উইলিয়ম কেরী শ্রীরামপুরে ব্যাপটিস্ট মিশন প্রতিষ্ঠা করেন। শ্রীরামপুরের মিশনারিদের উদ্যোগেই সর্বপ্রথম বাংলা ও অপরাপর ২৬টি ভারতীয় ভাষায় বাইবেলের অনুবাদ প্রকাশিত হয়। ভারতে মুদ্রাযন্ত্রের প্রবর্তন, প্রথম বাংলা সংবাদপত্র ‘সমাচার দর্পণ’ প্রকাশ (১৮১৮ খ্রিঃ) এবং বাংলা ও তামিল ভাষায় ব্যাকরণ রচনার গৌরবের অধিকারী তাঁরাই। কেরী ও তাঁর সহযোগীরা বাংলা গদ্য সাহিত্যের অন্যতম পথপ্রদর্শক রূপে চিহ্নিত। তাঁদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত মোট ১২৬টি বিদ্যালয়ে প্রায় দশ হাজার ভারতীয় ছাত্র পাশ্চাত্য শিক্ষার সুযোগ পায়। লন্ডন মিশনারি সোসাইটি-র রবার্ট মে চুঁচুড়ায় একটি ইংরেজী শিক্ষার বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। পরে তাঁর উদ্যোগে ৩৬টি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশন (১৮০০ খ্রিঃ), লন্ডন মিশনারি সোসাইটি (১৭৯৫ খ্রিঃ) ও চার্চ মিশনারি সোসাইটি-র (১৭৯৯) খ্রিঃ) উদ্যোগে কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল—এমনকি চুঁচুড়া, বর্ধমান, বহরমপুর, কালনা, মালদহ ও দক্ষিণ ভারতে বহু বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রধানত খ্রিস্টধর্ম-সংক্রান্ত শিক্ষা দেওয়া হলেও এইসব বিদ্যালয়গুলিতে ইতিহাস, ভূগোল, ব্যাকরণ প্রভৃতি বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হত। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে ব্যাপটিস্ট মিশন শ্রীরামপুরে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করে। বাংলায় স্কটিশ মিশনের প্রতিষ্ঠাতা আলেকজান্ডার ডাফ বেশ কয়েকটি ইংরেজী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য হল ‘জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইনস্টিটিউশন’ (বর্তমান স্কটিশ চার্চ কলেজ)। মিশনারিদের উদ্যোগে শিবপুরে ‘বিশপ কলেজ’ (১৮২০ খ্রি:), মাদ্রাজে ‘খ্রিস্টান কলেজ’ (১৮৩৭ খ্রিঃ), বোম্বাই-এ ‘উইলসন কলেজ’ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়। বেলজিয়াম থেকে আগত জেসুইট মিশনারিরা ‘সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ’ ও ‘লরেটো হাউস কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করেন।

এ সময় কয়েকজন মুক্তমনা ভারতীয় ও বিদেশীর উদ্যোগে বেশ কয়েকটি বেসরকারী বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। এইসব ব্যক্তিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন রামমোহন রায়, রাজা রাধাকান্ত দেব, দ্বারকানাথ ঠাকুর, বর্ধমানের রায় বাহাদুর তেজচন্দ্র রায়, জয়নারায়ণ ঘোষাল, ডেভিড হেয়ার প্রমুখ।

ডেভিড হেয়ার এবং রামমোহন রায় :

বাংলায় ইংরেজী শিক্ষা বিস্তারের ইতিহাসে স্কটল্যান্ডের ঘড়ি নির্মাতা ডেভিড হেয়ার এবং রামমোহন রায়ের নাম চিরস্মরণীয়। ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে রামমোহন রায় নিজ উদ্যোগে কলকাতায় ‘অ্যাংলো-হিন্দু স্কুল’ নামে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দের ২০শে জানুয়ারি ডেভিড হেয়ার, রাধাকান্ত দেব, বৈদ্যনাথ মুখোপাধ্যায় এবং সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি স্যার এডওয়ার্ড ডেভিড হেয়ার এবং রামমোহন রায় হাইড ইস্ট-এর উদ্যোগে ‘হিন্দু কলেজ’ (পরবর্তীকালে প্রেসিডেন্সী কলেজ, ১৮৫৫ খ্রিঃ) স্থাপিত হয়। কথিত আছে যে, এই কলেজ প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে রামমোহন রায় তাদের যথেষ্ট সহায়তা করেন, যদিও ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার এ ব্যাপারে ভিন্ন মত পোষণ করেন। ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দে হেয়ার কলকাতায় আরও একটি ইংরেজী বিদ্যালয় স্থাপন করেন (হেয়ার স্কুল)। এছাড়া, তাঁর উদ্যোগেই ইংরেজী ভাষায় পাঠ্যপুস্তক রচনা ও বিভিন্ন স্থানে ইংরেজী বিদ্যালয় স্থাপনের উদ্দেশ্যে যথাক্রমে ‘ক্যালকাটা স্কুল বুক সোসাইটি’ (১৮১৭ খ্রিঃ) এবং ‘ক্যালকাটা স্কুল সোসাইটি’ (১৮১৮ খ্রিঃ) প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে স্কটল্যান্ডের ধর্মপ্রচারক আলেকজান্ডার ডাফ কলকাতায় জেনারেল অ্যাসেম্বলিজ ইনস্টিটিউশন’ স্থাপনে উদ্যোগী হলে রামমোহন তাঁর প্রধান সহায়ক ছিলেন।

১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের সনদ আইন :

১৮১০ খ্রিস্টাব্দে গভর্নর জেনারেল মিন্টো এক রিপোর্টে ভারতে শিক্ষার শোচনীয় অবস্থার কথা তুলে ধরেন এবং ভারতীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে কোম্পানীর কাছে আর্থিক সাহায্যের ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের আবেদন জানান। খ্রিস্টান মিশনারিরাও ইংল্যান্ড ও ভারতে কোম্পানীর শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে থাকেন। এই সময় ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দের সনদ আইন পাস হয় এবং কোম্পানী আগামী বিশ বছরের জন্য ভারতে শাসনাধিকার পায়। এই আইনের একটি ধারায় বলা হয় যে, ভারতীয় জনশিক্ষার জন্য কোম্পানী ‘প্রতি বছর অন্তত এক লক্ষ টাকা ব্যয় করবো। এই মর্মে ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে কমিটি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন’ বা ‘জনশিক্ষা কমিটি’ গঠিত হয়। এই কমিটির সদস্যরা কলকাতায় একটি ‘সংস্কৃত কলেজ’ (১৮২৩ খ্রি:) প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কমিটির সদস্যগণের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রামমোহন রায় তদানীন্তন গভর্নর জেনারেল লর্ড আমহার্স্টকে একটি পত্র লেখেন (১১ই ডিসেম্বর, ১৮২৩ খ্রিঃ)। এই পত্রে তিনি সংস্কৃত শিক্ষার অসারতা প্রমাণ করে ভারতে আধুনিক বৈজ্ঞানিক ও ইংরেজী শিক্ষা প্রবর্তনের দাবি জানান। রামমোহন রায়ের এই পত্রটি ভারতীয় নবজাগরণের ইতিহাসে এক মূল্যবান দলিল।

লর্ড মেকলের প্রস্তাব :

লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্কের শাসনকালে (১৮২৮-৩৫ খ্রিঃ) সরকারি শিক্ষানীতিতে এক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে। এ সময় টমাস ব্যাবিংটন মেকলে নামে এক খ্যাতনামা পণ্ডিত তাঁর আইন সচিব হয়ে ভারতে আসেন এবং তিনি কমিটি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশনের সভাপতি নিযুক্ত হন। এ সময় কমিটি প্রাচ্য রীতি ও প্রতীচ্য রীতিতে শিক্ষাদান সম্পর্কে দুই দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এক দলকে বলা হত প্রাচ্যবাদী বা ওরিয়েন্টালিস্ট (Orientalist) এবং অপর দলটি ছিল পাশ্চাত্যবাদী বা অ্যাংলিসিস্ট (Anglicist)। উগ্র পাশ্চাত্যবাদী মেকলে প্রতীচ্য রীতিতে শিক্ষাদানের পক্ষপাতী ছিলেন। তাঁর সমর্থকদের মধ্যে ছিলেন আলেকজান্ডার ডাফ, সন্ডার্স, কলভিন প্রমুখ পাশ্চাত্যবাদিগণ। অপরপক্ষে, প্রাচ্যবিদ্যার সমর্থকদের মধ্যে ছিলেন বিশিষ্ট প্রাচ্যবিদ এইচ. টি. প্রিন্সেপ, কোলব্রুক ও উইলসন। তাঁরা প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য ও দর্শন সম্পর্কে শিক্ষাদানে আগ্রহী ছিলেন। ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের ২রা ফেব্রুয়ারি মেকলে তাঁর বিখ্যাত প্রস্তাব (Minutes) বড়লাটের কাছে পেশ করেন। (১) তিনি প্রাচ্যের সভ্যতাকে ‘দুর্নীতি, অপবিত্র ও নির্বুদ্ধিতা’ বলে অভিহিত করে সরাসরি পাশ্চাত্য শিক্ষার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। (২) তাঁর মতে প্রাচ্যের শিক্ষায় কোন বৈজ্ঞানিক চেতনা নেই এবং তা পাশ্চাত্য শিক্ষাব্যবস্থা অপেক্ষা সম্পূর্ণভাবে নিকৃষ্ট (“Oriental learning was completely Inferior to European learning.”)। (৩) তাঁর মতে, “ভাল ইওরোপীয় গ্রন্থাগারের একটি তাক আরব ও ভারতের সমগ্র সাহিত্যের সমকক্ষ” (“A single shelf of a good European library was worth the whole native literature of India and Arabia.”)। বলা বাহুল্য, মেকলের এই মত ছিল সম্পূর্ণভাবে অহমিকা প্রসূত ও অজ্ঞানতাপূর্ণ।

১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের ঘোষণা :

(৪) তিনি বলেন যে, উচ্চ ও মধ্যবিত্তদের মধ্যেইংরেজী শিক্ষা বিস্তৃত হলে তা ‘ক্রমনিম্ন পরিশ্রুত নীতি’ (Downward Filtration Theory) অনুযায়ী ধীরে ধীরে জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে। (৫) মেকলের লক্ষ্য ছিল সাংস্কৃতিক বিজয়। তিনি বলেন যে, পাশ্চাত্য শিক্ষার ফলে এমন এক ভারতীয় গোষ্ঠী তৈরি হবে যারা “রক্তে ও বর্ণে হবে ভারতীয়, কিন্তু রুচি, মত, নৈতিকতা এবং বুদ্ধিমত্তায় হবে ইংরেজ (“Indian in blood and colour, but English in tastes, in opinions, and in morals and intellect.”)। তারাই পরে জনগণের মধ্যে নতুন জ্ঞান প্রচার করবে এবং ইংরেজী শিক্ষার ফলে ভারতে নবজাগৃতি আসবে।” মেকলের বাগ্মিতা ও যুক্তির ফলে ইংরেজী শিক্ষার সমর্থনকারীরা জয়যুক্ত হন এবং ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের ৭ই মার্চ লর্ড বেন্টিঙ্ক ইংরেজী শিক্ষাকে সরকারি নীতিরূপে ঘোষণা করেন। এ সময় কলকাতা মেডিকেল কলেজ (১৮৩৫ খ্রিঃ), রুরকী-তে থমাসোন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, মাদ্রাজে মাদ্রাজ ইউনিভার্সিটি হাই স্কুল ও বোম্বাই-এ এলফিনস্টোন ইনস্টিটিউশন স্থাপিত হয়। এ প্রসঙ্গে স্মরণ রাখা দরকার যে, ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দের পর ইংরেজী শিক্ষা প্রসারে সরকার যে-সব ব্যবস্থা গ্রহণ করে তার মধ্যে কোন শৃঙ্খলা ছিল না, অর্থ বরাদ্দও ছিল অপ্রতুল এবং ভারতের সর্বত্র শিক্ষা বিস্তারে সরকারি উদ্যম একই রকমের ছিল না।

হার্ডিঞ্জের ঘোষণা :

১৮৪২ খ্রিস্টাব্দে ‘কমিটি অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন’ পুনর্গঠন করে ‘কাউন্সিল অব এডুকেশন’ গঠিত হয়। এই সংস্থার উদ্যোগে ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ১৫১টি ইংরেজী বিদ্যালয়ে ১৩ হাজারেরও বেশি ছাত্রের জন্য ইংরেজী শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে বড়লাট হার্ডিঞ্জ ঘোষণা করেন যে, সরকারি চাকরিতে ইংরেজী ভাষাজ্ঞানকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। এই ঘোষণার ফলে মধ্যবিত্ত বাঙালী সমাজে ইংরেজী শিক্ষার প্রবল আগ্রহ দেখা দেয় এবং দেশীয় শিক্ষাব্যবস্থার সমাধি রচিত হয়।

উডের ডেসপ্যাচ বা নির্দেশনামা :

১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের পর থেকে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বহু স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, কিন্তু এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির পাঠক্রম ও পঠনরীতির মধ্যে কোন সামঞ্জস্য ছিল না। ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দের ১৯শে জুলাই বোর্ড অব কন্ট্রোলের সভাপতি চার্লস উড ‘শিক্ষা-সংক্রান্ত এক নির্দেশনামা’ (Wood’s Despatch) প্রকাশ করেন। এই নির্দেশনামাকে ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা বিস্তারের ‘ম্যাগনা কার্টা’ বলা হয়। এই নির্দেশনামার ওপর ভিত্তি করেই মূলত আধুনিক ভারতের শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। সমগ্র শিক্ষাব্যবস্থাকে তিনি পাঁচটি শ্রেণীতে ভাগ করার নির্দেশ দেন। এই নির্দেশনামায় দেশের বিভিন্ন স্থানে আরও প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল এবং কলেজ প্রতিষ্ঠা, একটি শিক্ষা বিভাগ ও প্রেসিডেন্সী শহরগুলিতে (কলকাতা, বোম্বাই, মাদ্রাজ) তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, “ডিরেক্টর অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন’ পদ সৃষ্টি, নারী শিক্ষার প্রসার, সাধারণ শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে মাতৃভাষার ব্যবহার এবং শিক্ষক-শিক্ষণ ও মেধাবৃত্তি দান প্রভৃতির কথা বলা হয়।

 বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন :

এই সিদ্ধান্তের ফলে লর্ড ডালহৌসী প্রত্যেক প্রদেশে জনশিক্ষা দপ্তর স্থাপন করেন। ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা, বোম্বাই ও মাদ্রাজে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দেলাহোর এবং এলাহাবাদে বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। স্যার জেমস্ উইলিয়ম কোলভিল (Sir James William Colvile) ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য।


নারীশিক্ষা :

উনিশ শতকের সূচনায় ভারতে নারীশিক্ষার বিশেষ কোন প্রসার হয়নি। এদেশে নারীশিক্ষা বিস্তারে খ্রিস্টান মিশনারিরাই সর্বপ্রথম উদ্যোগী হন এবং এ ব্যাপারে শ্রীমতী কুক এবং লন্ডনের ‘চার্চ মিশনারি সোসাইটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।নারীশিক্ষা বিস্তারে  ‘কলকাতা স্কুল সোসাইটি (১৮১৭ খ্রিঃ), ফিমেল জুভেনাইল সোসাইটি’ (১৮১৯ খ্রিঃ) ও ‘লেডিজ সোসাইটি ফর নেটিভ ফিমেল এডুকেশন’ (১৮২৪ খ্রিঃ) বিশেষ সচেষ্ট হয়। এইসব উদ্যোগ বিশেষ ফলপ্রসূ হয়নি, কারণ কুসংস্কারাচ্ছন্ন ভারতীয় মন এ ব্যাপারে বিশেষ সাড়া দেয়নি। নারীশিক্ষা প্রবর্তনের ব্যাপারে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, ডেভিড হেয়ার, রাধাকান্ত দেব, দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেন। ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকারের আইন সদস্য ড্রিঙ্কওয়াটার বেথুন-এর উদ্যোগ ও বিদ্যাসাগরের চেষ্টায় হিন্দু বালিকা বিদ্যালয়’ স্থাপিত হয়। পরে এখানে একটি মহিলা কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। এগুলি বর্তমানে যথাক্রমে বেথুন স্কুল ও কলেজ নামে পরিচিত। বিদ্যাসাগরের ব্যক্তিগত উদ্যোগে নদীয়া, হুগলী, বর্ধমান ও মেদিনীপুরে একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।

ত্রুটি :

এই শিক্ষাব্যবস্থা ত্রুটিমুক্ত ছিল না। (১) শিক্ষার মাধ্যম ছিল ইংরেজী ভাষা। এর ফলে সাধারণ মানুষের কাছে শিক্ষার দ্বার উন্মুক্ত হয়নি। (২) কিছু কলেজ ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হলেও প্রাথমিক শিক্ষা অবহেলিত হওয়ায় দেশে নিরক্ষরতা বৃদ্ধি পায়। (৩) মুসলিম সমাজকে এই শিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট করা যায়নি। (৪) কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার দিকে কোন নজর দেওয়া হয়নি। (৫) স্ত্রীশিক্ষার বিশেষ কোন বিকাশ ঘটেনি। (৬) শিক্ষার আলো গ্রামাঞ্চলে দরিদ্র জনসাধারণের মধ্যে সম্প্রসারিত হয়নি। কেবল মুষ্টিমেয় কিছু শহুরে লোক এই শিক্ষা গ্রহণ করে। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয় যে, ফিলটারের জল যেমন ওপর থেকে নিচে নেমে আসে, তেমনি উচ্চ শিক্ষিত লোকেরা জনসাধারণের মধ্যে শিক্ষার বিস্তার ঘটাবে। বলা বাহুল্য, লর্ড মেকলের এই ‘downward filtration’ বা ‘নিম্নগামী পরিস্রাবণ’ তত্ত্ব বাস্তবায়িত হয়নি, কারণ ইংরেজী শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী সাধারণের মধ্যে শিক্ষাবিস্তারে আগ্রহী হয়নি।

ফলাফল :

ইংরেজী শিক্ষার সংস্পর্শে এসে ভারতবাসী পাশ্চাত্য সভ্যতা, জ্ঞান-বিজ্ঞান, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, মানবতাবাদ প্রভৃতি আদর্শের সঙ্গে পরিচিত হয় এবং নিজ সমাজ, ধর্ম, দেশ ও জাতির দুর্বলতাগুলি সহজেই অনুধাবন করতে পারে। ইংরেজী ভাষা শিক্ষিত ভারতবাসীকে ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ করে। বাংলা ও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে শুরু হয় যুক্তিবাদী সামাজিক ও ধর্মীয় আন্দোলন, সাহিত্যে দেখা দেয় জাতীয়তার প্লাবন এবং তারপর আসে রাজনৈতিক আন্দোলনের জোয়ার। সাহিত্য, ধর্ম, সমাজ, রাজনীতি— জীবনের সর্বক্ষেত্রেই এক নবচেতনার সঞ্চার হয়।

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.