আগের অধ্যায়ে আমরা সমাক্ষরেখা [ parallels of latitude] সম্পর্কে আলোচনা করেছিলাম। এই অধ্যায়ে আমরা দ্রাঘিমারেখা [ longitude] সম্পর্কে আলোচনা করব।
3.4. দ্রাঘিমা (Longitude) :
ভূ-গোলকে অবস্থিত কোনো স্থানের সঙ্গে মূল মধ্যরেখা বা গ্রীনিচ রেখার কৌণিক পরিমাপকে ঐ স্থানের দ্রাঘিমা বা দ্রাঘিমাংশ বলে। মূল মধ্যরেখার পূর্বে অবস্থিত কোনো স্থানের দ্রাঘিমা পূঃ এবং পশ্চিমে অবস্থিত কোনো স্থানের দ্রাঘিমা পঃ দিয়ে চিহ্নিত করা হয়। ভূ-গোলকে দ্রাঘিমা উভয় গোলার্ধে (পূর্ব অথবা পশ্চিম) ০°- ১৮০° পর্যন্ত হয়। সাধারণভাবে কোনো স্থানের দ্রাঘিমা ৮০°১০´ ১৫” পূঃ এভাবে লেখা হয়। যেমন—কলকাতা শহরের দ্রাঘিমা ৮৮°৩০´ পূঃ, অর্থাৎ কলকাতা ও গ্রীনিচ রেখার মধ্যে কৌণিক দূরত্ব ৮৮° ৩০’।
ভূ-গোলকে ০° বা নিরক্ষরেখায় ১° দ্রাঘিমার দৈর্ঘ্য ১১১.৩ কিমি.। এটা নির্ণয় করা হয় পৃথিবীর পরিধি ও মোট কৌণিক পরিমাপের সাহায্যে যথা ৪০,০৭৫ ৩৬০ কিমি /৩৬০°= ১১১ কিমি. (প্রায়) । নিরক্ষরেখা থেকে যতই উত্তর ও দক্ষিণে যাওয়া যায় ততই ১° দ্রাঘিমার দৈর্ঘ্য কমতে থাকে এবং মেরুদ্বয়ে এটা ০-এ পরিণত হয়।
3.4.1. দ্রাঘিমা নির্ণয় (Determination of Longitude) :
[i] কৌণিক পদ্ধতিতে দ্রাঘিমা নির্ণয়— পৃথিবীর উত্তর-দক্ষিণে মেরুদ্বয়কে যুক্ত করে ভূ-কেন্দ্রে ওপর দিয়ে অঙ্কিত রেখাটির নাম মূল মধ্যরেখা। এবার ভূ-পৃষ্ঠে অবস্থিত কোনো স্থান থেকে একটি সরলরেখা অঙ্কন করা হলো এবং ধরা যাক এর ফলে মূল মধ্যরেখা থেকে নিরক্ষীয় তল পর্যন্ত একটি ৬০° কোণ উৎপন্ন হলো। এভাবে স্থানটির দ্রাঘিমা ৬০° নির্ণয় করা গেল। যদি স্থানটি মূল মধ্যরেখার পূর্বদিকে অবস্থিত হয় তবে দ্রাঘিমা ৬০° হবে।
[ii] স্থানীয় সময়ের ভিত্তিতে— দু’টি স্থানের মধে স্থানীয় সময়ের পার্থক্য অনুসারেও দ্রাঘিমা নির্ণয় করা যায়। প্রতি ১° দ্রাঘিমায় সময়ের প্রভেদ ৪ মিনিট। যদি কোনো বিশেষ দু’টি স্থানের মতে সময়ের প্রভেদ ১ ঘণ্টার হয় এবং এক স্থানের দ্রাঘিমা জানা থাকে তবে অন্য স্থানটির দ্রাঘিমা = প্রদত্ত স্থানটির দ্রাঘিমা ১৫°।
[iii] গ্রীনিচের সাহায্যে দ্রাঘিমা নির্ণয়— তবে বাস্তবক্ষেত্রে কোনো স্থানের দ্রাঘিমা নির্ণয় করার জন্য স্থানীয় সময়ের পার্থক্য এবং গ্রীনিচ সময়ের পার্থক্য ব্যবহার করা হয়। যেমন—প্রতি ১° দ্রাঘিমায় ৪ মিনিট এবং প্রতি ১৫° দ্রাঘিমায় ১ ঘণ্টা সময়ের পার্থক্য হয়। যদি দু’টি স্থানের মধ্যে সময়ের পার্থক্য এবং কোনো একটি স্থানের দ্রাঘিমা জানা থাকে, তবে এভাবে অন্য স্থানটির দ্রাঘিমা বার করা যাবে। আবার, গ্রীনিচের দ্রাঘিমা ০° ধরে ভূ-পৃষ্ঠের যে-কোনো স্থানের সময় গ্রীনিচ গড় সময় থেকে বিয়োগ বা গ্রীনিচের সময়ের সঙ্গে যোগ করে সময়ের পার্থক্য এবং দ্রাঘিমার পার্থক্য পাওয়া সম্ভব।
3.5. দ্রাঘিমারেখা (Meridians of Longitude) :
মূল মধ্যরেখা বা গ্রীনিচ রেখার পূর্ব ও পশ্চিমে একই দ্রাঘিমায় অবস্থিত স্থানগুলির মধ্য দিয়ে অঙ্কিত কাল্পনিক রেখাগুলিকে দ্রাঘিমারেখা বা দেশান্তররেখা বলে। প্রত্যেকটি দ্রাঘিমারেখা নিরক্ষরেখাকে সমকোণে ছেদ করে উভয় মেরুতে মিলিত হয়। প্রত্যেকটি দ্রাঘিমারেখা এক-একটি অর্ধবৃত্ত এবং পরস্পরের ঠিক বিপরীতে অবস্থিত দু’টি দ্রাঘিমারেখা এক-একটি মহাবৃত্ত।
একটি ভূ-গোলকে অসংখ্য দ্রাঘিমারেখা অঙ্কন করা যায়। যদি ১° অন্তর দ্রাঘিমারেখাগুলি অঙ্কন করা হয় তবে ভূ-গোলকে মোট ৩৬০টি দ্রাঘিমারেখা পাওয়া যাবে। তবে প্রয়োজনে এগুলি ১’ বা ১’’ অন্তরও অঙ্কন করা যেতে পারে। দ্রাঘিমারেখাগুলির সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন মান যথাক্রমে ১৮০° ও ০° ।
3.5.1. দ্রাঘিমারেখার বৈশিষ্ট্য (Characteristics of Meridians of Longitude)
(i) দ্রাঘিমারেখা প্রকৃত উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত রেখা। (ii) দু’টি দ্রাঘিমারেখার মধ্যে ব্যবধান বা দূরত্ব নিরক্ষরেখায় সবচেয়ে বেশি এবং উত্তর-দক্ষিণে ব্যবধান ক্রমশ কমতে থাকে ও পরে মেরুদ্বয়ে এগুলি বিন্দুতে পরিণত হয়। (iii) প্রত্যেকটি দ্রাঘিমারেখা এক একটি অর্ধবৃত্ত। [iv] একটি গোলকে অসংখ্য দ্রাঘিমারেখা অঙ্কন করা যায় এবং প্রত্যেক স্থানই কোনো না কোনো দ্রাঘিমারেখার ওপর অবস্থিত । [v] প্রত্যেক দ্রাঘিমারেখা নিরক্ষরেখাকে সমকোণে ছেদ করে। (vi) একই দ্রাঘিমারেখার সর্বত্র একই সময়ে সূর্যোদয়, মধ্যাহ্ন ও সূর্যাস্ত হয়।
3.5.2. কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দ্রাঘিমারেখা (Some Important Meridians Longitude) :
[] মূল মধ্যরেখা বা গ্রীনিচরেখা (Prime meridian or Greenwich line ) ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জের রাজধানী লন্ডন শহরের পূর্বদিকে গ্রীনিচ শহরের ওপর দিয়ে কল্পিত দ্রাঘিমারেখাটিকে মূল মধ্যরেখা বা গ্রীনিচরেখা বলে। এর দ্রাঘিমা ০°। মূল মধ্যরেখা পৃথিবীকে পূর্ব-পশ্চিমে দু’টি সমান অর্ধে বিভক্ত করেছে; যথা— পূর্ব গোলার্ধ (Eastern hemisphere) এবং পশ্চিম গোলার্ধ (Western hemisphere)। ভারত ৬৮° পূঃ—৯৭° পূঃ দ্রাঘিমার মধ্যে অবস্থিত বলে, একে পূর্ব গোলার্ধের দেশ বলে।
(ii) আন্তর্জাতিক তারিখরেখা (International date line )– ১৮০° দ্রাঘিমারেখাটির নাম আন্তর্জাতিক তারিখরেখা। সময় ও তারিখ গণনার ক্ষেত্রে এই রেখাটির বিশেষ গুরুত্ব আছে ।
3.6. দ্রাঘিমা ও সময়ের মধ্যে সম্পর্ক (Longitude and its Relation with Time ) :
দ্রাঘিমার সঙ্গে সময়ের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। পৃথিবী ক্রমাগত পশ্চিম থেকে পূর্বে আবর্তিত হচ্ছে এবং এর ফলে ভূ-পৃষ্ঠেও সময়ের পরিবর্তন ঘটে। পৃথিবীর একটি সম্পূর্ণ আবর্তনকালকে প্রায় ২৪ ঘণ্টা ধরা হয়।যে-কোনো গোলকের মোট কৌণিক পরিমাপ ৩৬০°। পৃথিবী ৩৬০° দ্রাঘিমা পথ ২৪ ঘণ্টায় অতিক্রম করে। সুতরাং পৃথিবী প্রতি ১৫° (= ৩৬০°/২৪ঘঃ ) দ্রাঘিমা ১ ঘণ্টায়; প্রতি ১° দ্রাঘিমা ৪ মিনিটে এবং প্রতি ১’ দ্রাঘিমা ৪ সেকেণ্ডে অতিক্রম করে। যেহেতু পৃথিবী পশ্চিম থেকে পূর্বে আবর্তিত হয়, সেই কারণে ভূ-পৃষ্ঠে যে স্থান যত পূর্বে অবস্থিত সেই স্থানে তত আগে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত এবং সময়ও এগিয়ে থাকে। অপর দিকে, কোনো স্থান যত পশ্চিম দিকে অবস্থিত হবে ততই সেখানে সময়ও পিছিয়ে থাকবে এবং সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তও পরে হবে। যখন সূর্য কোনো স্থানে ঠিক মাথার ওপর থাকে, অর্থাৎ ছায়ার দৈর্ঘ্য হ্রস্বতম হয়, তখন সেখানে মধ্যাহ্ন (noon) বা বেলা ১২টা বাজে। মধ্যাহ্নের পূর্ববর্তী ১২ ঘন্টাকে ante meridian বা a.m. এবং পরবর্তী ১২ ঘণ্টাকে post meridian বা p.m. বলে।
3.7. অক্ষরেখা ও দ্রাঘিমারেখার মধ্যে তুলনা (Comparison between Parallels of Latitude and Parallels of Longitude) :
অক্ষরেখা | দ্রাঘিমারেখা |
১। প্রত্যেকটি অক্ষরেখা প্রকৃত পূর্ব-পশ্চিম রেখা। এগুলি পৃথিবীকে পূর্ব-পশ্চিমে বেষ্টন করে আছে। | ১। প্রত্যেকটি দ্রাঘিমারেখা প্রকৃত উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত রেখা। এগুলি গোলকে পৃথিবীকে উত্তর-দক্ষিণে বেষ্টন করে আছে। |
২। অক্ষরেখার ব্যাস নিরক্ষরেখায় সর্বাধিক -পৃথিবীর ব্যাসের সমান এবং ব্যাস উত্তর-দক্ষিণে ক্রমশ হ্রাস পায়। | ২। প্রত্যেকটি দ্রাঘিমারেখার ব্যাস পৃথিবীর ব্যাসের অর্ধেক। |
৩। অক্ষরেখাগুলির মধ্যে একমাত্র নিরক্ষরেখা বা বিষুবরেখা মহাবৃত্ত, অন্য সব ক’টি অক্ষরেখা এক একটি ক্ষুদ্রবৃত্ত। | ৩। দ্রাঘিমারেখাগুলির প্রত্যেকটি এক একটি অর্ধবৃত্ত। |
৪। প্রত্যেকটি অক্ষরেখা পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে সমান্তরাল অর্থাৎ দু’টি অক্ষরেখার মধ্যে দূরত্ব সর্বদাই সমান থাকে। | ৪। দ্রাঘিমারেখাগুলি পরস্পর পরস্পরের মত সমান্তরাল নয়। দু’টি দ্রাঘিমারেখার মধ্যে ব্যবধান নিরক্ষরেখায় সবচেয়ে বেশি এবং উত্তর-দক্ষিণে ব্যবধান ক্রমশ কমতে থাকে ও পরে মেরুদ্বয়ে ঐগুলি বিন্দুতে পরিণত হয়। |
৫। একটি গোলকে অসংখ্য দ্রাঘিমারেখা অঙ্কন করা যায় এবং প্রত্যেকটি স্থানই কোনো-না-কোনে দ্রাঘিমারেখার ওপর অবস্থিত। | ৫। একটি গোলকে অসংখ্য অক্ষরেখা অঙ্কন করা যায়। কেবলমাত্র মেরুদ্বয় ছাড়া গোলকের অন্য যে-কোনো স্থানই কোনো-না-কোনো অক্ষরেখার ওপর অবস্থিত। |
৬। একই অক্ষরেখার সর্বত্র একই সময় সূর্যোদয়, মধ্যাহ্ন ও সূর্যাস্ত হয় না। | ৬। একই দ্রাঘিমারেখার সর্বত্র একই সময়ে সূর্যোদয়, মধ্যাহ্ন ও সূর্যাস্ত হয়। |
৭। অক্ষরেখা দ্রাঘিমারেখাগুলিকে সমকোণে ছেদ করে। | ৭ । প্রত্যেকটি দ্রাঘিমারেখা নিরক্ষরেখাকে সমকোণে ছেদ করে। |
৮। অক্ষরেখার সর্বোচ্চ মান ৯০°। | ৮। দ্রাঘিমারেখার সর্বোচ্চ মান ১৮০°। |
৯। অক্ষরেখা সময় গণনায় সাহায্য করে না। | ৯। দ্রাঘিমারেখা সময় গণনায় সাহায্য করে। |
১০। অক্ষরেখা কোনো স্থানের জলবায়ু, স্বাভাবিক উদ্ভিদ, মানুষের প্রণালী ইত্যাদি সম্পর্কে একটি সম্যক ধারণা জন্মাতে সাহায্য করে। | ১০। দ্রাঘিমারেখা কোনো স্থানের জলবায়ু স্বাভাবিক উদ্ভিদ, মানুষের জীবনযাত্রা প্রণালী ইত্যাদি সম্বন্ধে কোনো ধারণা জন্মাতে সাহায্য করে না । |
Difference between latitude and longitude
3.8. বিভিন্ন প্রকার সময় (Different Types of Time) •
3.8.1. স্থানীয় সময় (Local time) : যখন কোনো একটি স্থানে সূর্য ঠিক মাথার ওপর থাকে বা যখন সূর্যরশ্মির ছায়া প্রকৃত উত্তর দিকে মুখ করে পতিত হয়, তখন সেখানে বেলা ১২টা বা মধ্যাহ্ন হয়। এভাবে সূর্যের শিরবিন্দুতে অবস্থানের দ্বারা যে সময় নিরূপণ করা হয়, তাকেই স্থানীয় সময় বলে। তবে এক্ষেত্রে মধ্যাহ্ন সূর্যের গড় অবস্থানের সাহায্যে সময় নিরূপণ করা দরকার। স্থানীয় সময়কে এ কারণে গড় সূর্য সময় ( mean solar time)-ও বলা হয়। একই দ্রাঘিমায় অবস্থিত যে-কোনো স্থানের স্থানীয় সময় এক ও অভিন্ন। সূর্য-ঘড়ির (solar clock) সাহায্যেও স্থানীয় সময় নিরূপণ করা যেতে পারে।
স্থানীয় সময়ের ব্যবহারিক গুরুত্ব অত্যন্ত কম। একই দেশের বিভিন্ন দ্রাঘিমায় অবস্থিত স্থানে স্থানীয় সময় ভিন্ন ভিন্ন প্রকার। ফলে ডাক চলাচল, রেল বা বিমান চলাচল, টেলি-যোগাযোগ, ইত্যাদি বিষয়ে নানা প্রকার সমস্যা দেখা যায়। এসব কারণে কোনো দেশেই স্থানীয় সময় ব্যবহৃত হয় না।
3.8.2. প্রমাণ সময় (Standard time) :
স্থানীয় সময়ের অসুবিধার জন্য পৃথিবীর প্রত্যেক দেশেই প্রমাণ সময়ের সাহায্যে সময় নিরূপণ করা হয়। সাধারণত দেশের মধ্যবর্তী কোনো দ্রাঘিমায় যে স্থানীয় সময় হয়, তাকেই ঐ দেশের সর্বত্র প্রমাণ সময় রূপে ধরা হয়। এক্ষেত্রে সর্বদাই সময় গ্রীনিচ সময়কে ভিত্তি করে নিরূপিত হয়। যেমন, ভারত ৬৮° পূঃ— ১৭° পূঃ দ্রাঘিমা পর্যন্ত বিস্তৃত হওয়ায় ৮২ পূ দ্রাঘিমার ভিত্তিতে প্রমাণ সময় হিসাব করা হয়। উত্তরপ্রদেশের এলাহাবাদ শহর ৮২ পূঃ দ্রাঘিমায় অবস্থিত বলে ভারতীয় প্রমাণ সময় (Indian Standard Time or I.S.T.) এবং এলাহাবাদের স্থানীয় সময় এক ও অভিন্ন। এরূপ কারণে বাংলাদেশের প্রমাণ সময় ভারতীয় প্রমাণ সময় অপেক্ষা ৩০ মিনিট অগ্রগামী। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মতো পূর্ব-পশ্চিমে বেশি বিস্তৃত দেশে ৬টি প্রমাণ সময় অঞ্চল (standard time zone) আছে। এগুলি হলো—পূর্বের প্রমাণ সময় (৭৫° পঃ), মধ্যভাগের প্রমাণ সময় (৯০° পঃ ), পার্বত্য প্রমাণ সময় (১০৫° প: ), প্রশান্ত মহাসাগরীয় প্রমাণ সময় (১২০° পঃ), আলাস্কা প্রমাণ সময় (১৫০° পঃ) এবং হাওয়াই প্রমাণ সময় (১৫০° পঃ)।
3.8.3. গ্রীনিচ গড় সময় (Greenwich Mean Time or G.M.T.) :
ব্রিটি দ্বীপপুঞ্জে লন্ডনের সামান্য পূর্বে অবস্থিত গ্রীনিচ শহরের ওপর দিয়ে কল্পিত মূল অতিক্রম করেছে। এই গ্রীনিচ শহরের সময়কে গ্রীনিচ সময় বলে। যেহেতু গ্রীনিচ সময় থেকে পৃথিবীর সর্বত্র প্রমাণ সময় বার করা হয়, সেই কারণে গ্রীনিচের সময়কে গ্রীনিচ গড় সময়ও বলে। ক্রোনোমিটার (Chronometer) নামে ঘড়ির সাহায্যে গ্রীনিচের সময়, সর্বদা জান যায়। যে-কোনো জাহাজে এই ঘড়ি থাকে। যেমন—ভারতীয় প্রমাণ সময় গ্রীনিচ গড় সময় থেকে ৫ ঘন্টা ৩০ মিনিট অগ্রগামী।
3.9. দ্রাঘিমার সাহায্যে সময় এবং সময়ের সাহায্যে দ্রাঘিমা নির্ণয় (Determination of time with the help of Meridian and Meridian with the help of Time)
পৃথিবীর মোট কৌণিক পরিমাপ ৩৬০° এবং পৃথিবী প্রায় ২৪ ঘণ্টায় ৩৬০° দ্রাঘিমা অতিক্রম করে। এরূপ কারণে প্রতি ১৫° দ্রাঘিমায় ১ ঘণ্টা, প্রতি ডিগ্রি দ্রাঘিমায় ৪ মিনিট এবং প্রতি মিনিট দ্রাঘিমায় ৪ সেকেণ্ড সময়ের প্রভেদ হয়। পৃথিবী পশ্চিম থেকে পূর্বে অর্থাৎ ঘড়ির কাঁটার বিপরীতক্রমে আবর্তন করে। এ কারণে পূর্ব দিকে অবস্থিত স্থানসমূহে সময় এগিয়ে থাকে এবং পশ্চিমদিকের স্থান- সমূহে সময় পিছিয়ে থাকে। প্রথমে দ্রাঘিমা বা সময়ের প্রভেদ নিরূপণ করার পর প্রদত্ত দ্রাঘিমা বা সময়ের সঙ্গে নির্ণীত দ্রাঘিমা বা সময় যোগ বা বিয়োগ করলে নির্ণেয় স্থানের দ্রাঘিমা বা সময় বার করা যায়।
দ্রাঘিমা বা সময় নিরূপণ করার সময় কয়েকটি বিষয় স্মরণ রাখা প্রয়োজন :
[১] যদি প্রদত্ত ও নির্ণেয় স্থান একই গোলার্ধে অবস্থিত হয়, তবে দ্রাঘিমান্তর বা সময়ের প্রভেদ নিরূপণ করার জন্য বড় দ্রাঘিমা বা সময় থেকে ছোট দ্রাঘিমা বা সময় বিয়োগ কর।
[২] যদি প্রদত্ত স্থান ও নির্ণেয় স্থান বিপরীত গোলার্ধে অবস্থিত হয়, তবে দ্রাঘিমান্তর নিরূপণ করার জন্য উভয় স্থানের দ্রাঘিমা যোগ কর। সময়ের প্রভেদ বার করার জন্য অবশ্য বেশি সময় থেকে কম সময় বিয়োগ কর।
[৩] দ্রাঘিমা নির্ণয় করার সময় যদি প্রদত্ত দ্রাঘিমা থেকে দ্রাঘিমান্তর বিযোগ করা না যায়, তার দ্রাঘিমান্তর থেকে প্রদত্ত দ্রাঘিমা বিয়োগ কর। এক্ষেত্রে প্রদত্ত স্থানটি যে গোলার্ধে অবস্থিত, নির্ণেয় স্থানটির দ্রাঘিমা তার বিপরীত গোলার্ধে হবে।
[৪] কোনো স্থানের সময় থেকে যদি নির্ণীত সময়ের প্রভেদ বিয়োগ করা না যায়, তবে প্রদত্ত স্থানের সময়ের সঙ্গে ১২ ঘণ্টা (P.M. হলে) অথবা ২৪ ঘণ্টা (A.M. হলে) যোগ কর।
[৫] যদি প্রদত্ত স্থান অপেক্ষা নির্ণেয় স্থান পূর্বে অবস্থিত হয়, তবে দ্রাঘিমা বা সময় নিরূপণের জন্য খাটি দ্রাঘিমান্তর বা সময়ের প্রভেদ প্রদত্ত স্থানের দ্রাঘিমা বা সময়ের সঙ্গে যোগ কর। যদি নির্ণেয় স্থানটি থেকে প্রদত্ত স্থানের পশ্চিমে অবস্থিত হয়, তবে যোগের পরিবর্তে বিয়োগ কর।
3.10. আন্তর্জাতিক তারিখ রেখা (International Date Line) :
১৮০° দ্রাঘিমা রেখাটিকে আন্তর্জাতিক তারিখ রেখা বলে। গ্রীনিচ (০°) থেকে ক্রমাগত পূর্বদিকে অগ্রসর হয়ে ১৮০° দ্রাঘিমায় পৌঁছোলে সেখানকার সময় গ্রীনিচ সময় অপেক্ষা ১২ ঘণ্টা এগিয়ে থাকবে। আবার গ্রীনিচ থেকে ক্রমাগত পশ্চিমদিকে অগ্রসর হয়ে ১৮০° দ্রাঘিমায় পৌঁছোলে স্থানীয় সময় গ্রীনিচ সময় অপেক্ষা ১২ ঘণ্টা পিছিয়ে থাকবে। অর্থাৎ একই দ্রাঘিমায় সময়ের প্রভেদ বা ব্যবধান হবে ২৪ ঘণ্টার। এই কারণে পশ্চিম গোলার্ধ থেকে আন্তর্জাতিক তারিখ রেখা অতিক্রম করে পূর্ব গোলার্ধে প্রবেশ করলে সময় পুরো ২৪ ঘণ্টা বা ১ দিন বৃদ্ধি পাবে, আবার পূর্ব গোলার্ধ থেকে পশ্চিম গোলার্ধে প্রবেশ করলে সময় ১ দিন হ্রাস পাবে।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, উত্তর আমেরিকা থেকে পূর্ব গোলার্ধে প্রবেশ করছে এমন জেট বিমান বা জাহাজ মঙ্গলবার বিকাল ৫টায় ১৮০° দ্রাঘিমা রেখা অতিক্রম করা মাত্রই সময় বিকাল ৫টা, বুধবার হবে। আবার, এশিয়া থেকে কোনো বিমান বা জাহাজ রবিবার রাত ৮টায় আন্তর্জাতিক তারিখ রেখা অতিক্রম করে পশ্চিম গোলার্ধে প্রবেশ করা মাত্রই সময় ১ দিন হ্রাস পেয়ে শনিবার, রাত ৮টা হবে।
এরূপ বৈশিষ্ট্যের জন্য ১৮৮৪ সালে ওয়াশিংটন ডি.সি.-তে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক দ্রাঘিমা সভায় (International Meridian Conference) ১৮০° দ্রাঘিমা রেখাটিকে আন্তর্জাতিক তারিখ রেখা নামকরণ করা হয়। যেহেতু ১৮০° দ্রাঘিমা রেখাটি সাইবেরিয়া এবং ওশিয়ানিয়ার বেশ কয়েকটি ছোট ছোট দ্বীপের ওপর দিয়ে অতিক্রম করেছে এবং এর ফলে সময় ও দিন গণনার ক্ষেত্রে গুরুতর অসুবিধা দেখা দেবে, সেই কারণে আন্তর্জাতিক তারিখ রেখাটিকে সর্বদাই জলভাগের ওপর দিয়ে অঙ্কন করা হয়েছে। যেমন, একে স্বাভাবিক অবস্থান থেকে ডানদিকে (পূর্ব) বাকিয়ে বেরিং প্রণালীর ওপর দিয়ে, অ্যালিউশিয়ান দ্বীপপুঞ্জের কাছে বাঁদিকে (পশ্চিম) প্রায় ১১ বাঁকিয়ে এবং এলিস্, ওয়ালিস্, ফিজি ও টোঙ্গা – দ্বীপপুঞ্জের কাছে ডানদিকে (পূর্ব) প্রায় ৭২ বাকিয়ে অঙ্কন করা হয়েছে। এক অর্থে আন্তর্জাতিক তারিখ রেখাটি তারিখ বিভাজিকা (date line divider) রূপে কাজ করে।