ভারতে সভ্যতার উদয় (PART-1)

Harappan Civilization

 

প্রশ্ন : হরপ্পা সভ্যতাকে নাগরিক সভ্যতা বলবার কারণ কি ?

উত্তর : হরপ্পা সভ্যতার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল তার নগরভিত্তিক বা নাগরিক সভ্যতা। অর্থাৎ নগরের বাসিন্দারা যেসব সুযোগ-সুবিধা সাধারণভাবে পেয়ে অভ্যস্ত সেইসব হরপ্পার মানুষ ও ভোগ করত। প্রশস্ত রাস্তা, বিনাক্ত জলনিকাশী ব্যবস্থা, রাস্তার ধারে সারিবদ্ধ বাড়ী, দোকানঘর, খাদ্য-পানীয়ের দোকান প্রভৃতি আধুনিক শহরের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। হরপ্পা সভ্যতার অন্তর্গত মহেঞ্জোদড়ো, হরপ্পা এবং আরও অনেক শহরে এইসব নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে। তাই হরপ্পা সভ্যতাকে অনায়াসেই নাগরিক সভ্যতা বলে অভিহিত করা যায়। হরপ্পার অর্থনৈতিক জীবনও শহরকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল। যে কারণে ঐ সভ্যতার নাগরিক বৈশিষ্ট্যের কথা সহজেই অনুমেয়।

প্রশ্ন : হরপ্পা- সভ্যতার মানুষের অর্থনৈতিক জীবনের পরিচয় দাও।

উত্তর : হরপ্পা সভ্যতার যুগে মানুষের অর্থনৈতিক জীবন কৃষি এবং ব্যবসা-বাণিজ্যকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল। ভূতল থেকে যেসব নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে তা থেকে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, কৃষি-উৎপাদন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, অনেকে ব্যবসা-বাণিজ্য করেও জীবিকা নির্বাহ করতে পারত। সে আমলে তো আর এখনকার মতো ভারী শিল্পদ্রব্যাদি তৈরী হত না। যে-করণে দেখা যায় তামা এবং ব্রোঞ্জের হাতিয়ার এবং যন্ত্রপাতি ছাড়া কৃষিপণ্যই ছিল ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রধান উপকরণ। গম, যব, মটর, কলাই যেমন উৎপন্ন হত প্রচুর, তেমনিভাবে তুলার উৎপাদন বেশি ছিল বলেই তা থেকে সুতীবস্ত্র তৈরী করতে অসুবিধা হয়নি। ব্যবসা-বাণিজ্য যে জোরদারভাবে চলতো তার পরিচয পরিচয় ও  পাওয়া গিয়েছে। এক একটি পরিবার এক একটি  চিহ্ন বা প্রতীক নিয়ে ব্যাবসা বাণিজ্য করত।  এইভাবে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে হরপ্পার মানুষ যথেষ্ট উন্নতি করেছিল বলা যেতে পারে। 

প্রশ্ন : হরপ্পা সভ্যতার নগর পরিকল্পনার বৈশিষ্ট্য কি ছিল ?

উত্তর : হরপ্পা-সভ্যতার নগর-পরিকল্পনা গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে, এই সভ্যতার অন্তর্ভুক্তি নগরসমূহকে আধুনিক শহরের সঙ্গে তুলনা করা যায়। আজ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে হরপ্পার নগর-নির্মাতারা প্রশস্ত রাস্তা নির্মাণ করতে জানতেন। নগরবাসীদের স্বাস্থ্যের দিকে লক্ষ্য রেখেই ময়লা জল নিষ্কাশনের জন্য আজকালকার মতো কুণ্ড তৈরী করা হত যেগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করবার ব্যবস্থাও ছিল। ঐতিহাসিক গর্ডন চাইল্ড (Gordon Childe) মন্তব্য করেছেন যে, হরপ্পা, সভ্যতার নগরগুলোতে পৌরসভার অস্তিত্ব না থাকলে রক্ষণাবেক্ষণের কাজ করা সম্ভব হত না। যে কারণে তিনি হরপ্পা সভ্যতায় পৌরসভার অস্তিত্বকে উড়িয়ে দেননি। হরপ্পা বা মহেঞ্জোদড়ো নগরীতে ছোট বা বড় বড় যে সারিবদ্ধ বাড়ীর প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে, সেগুলো পরিকল্পনা অনুযায়ী-ই নির্মিত হয়েছিল। বৃহৎ স্নানাগার বা শস্যভাণ্ডার নির্মাণের উদ্দেশ্য থেকেও নগর পরিকল্পনাকারীদের চিন্তাধারার উৎকর্ষের প্রমাণ পাওয়া যায়। 

 প্রশ্ন : হরপ্পা সভ্যতার আমলের ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কে যা জান সংক্ষেপে লেখ।

উত্তর : হরপ্পা সভ্যতা ছিল নগর-সভ্যতা। অর্থাৎ এই সভ্যতা  নগরকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল। যে কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারের কথা সহজেই অনুমান করা যায়। কারণ ব্যবসা-বাণিজ্য নগর সভ্যতার-ই বৈশিষ্ট্য। হরপ্পা সভ্যতার মানুষ যে পাইকারী এবং খুচরা মালপত্র বিক্রী করত তার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। তবে গবেষণার মাধ্যমে আজকে একথা সকলেই প্রায় মেনে নিয়েছেন যে হরপ্পা সভ্যতার সঙ্গে বিদেশের বিভিন্ন দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল। যেমন : মেসোপটেমিয়া, মিশর, মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন জায়গার সঙ্গে। ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে হরপ্পাবাসীরা যে মেসোপটেমিয়া বা মিশরে যাতায়ার করত তার প্রমাণ পাওয়া যায় এদেশের সীলমোহর সেদেশে আবিষ্কার থেকে। তাছাড়া হরপ্পার নৌকা এবং জলযানের যে ক্ষুদ্র সংস্করণ আবিষ্কৃত হয়েছে তা থেকেও বোঝা যায় যে সে-যুগের মানুষ জলপথে যাতায়াত করে থাকবে।

প্রশ্ন : হরপ্পা-সভ্যতার যুগে মানুষের ধর্মীয় জীবনের পরিচয় দাও। 

উত্তর : প্রথমেই মনে রাখতে হবে যে, হরপ্পাবাসীদের ধর্মজীবনের পরিচয় বহন করে এমন নিদর্শন খুব বেশি পাওয়া যায়নি। এমতাবস্থায় পরোক্ষভাবে যা জানা গিয়েছে তার ভিত্তিতেই ধর্মীয় জীবনের ইতিহাস রচিত হয়েছে। মহেঞ্জোদড়ো বা হরপ্পা নগরীতে কোনও মন্দির বা উপাসনা-গৃহের নিদর্শন পাওয়া যায়নি। তবে সীলমোহরে খোদাই করা অনেক মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে যাকে দেবদেবী বলে গ্রহণ করা যেতে পারে। তিনটি শৃঙ্গবিশিষ্ট একজন যোগীপুরুষকে বর্তমানের পশুপতি শিবের আদিরূপ বলে মনে করা হয়। সেই আমলে নানা জীবজন্তু, বৃক্ষ, সাপ প্রভৃতির পূজা প্রচলিত ছিল বলে মনে হয়। পরবর্তী কালের আর্যদের সঙ্গে হরপ্পাবাসীদের ধর্মীয় জীবনের অনেকখানি পার্থক্য ছিল।

প্রশ্ন : হরপ্পা সভ্যতার অবসান সম্ভাব্য কি কি কারণে ঘটেছিল?  অথবা  হরপ্পা-সভ্যতার পতন কিভাবে ঘটে থাকতে পারে?

উত্তর : হরপ্পা-সভ্যতা কিভাবে বিলুপ্ত হয়েছিল তা সঠিকভাবে নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। এই বিষয়ে ঐতিহাসিক বা গবেষকদের মধ্যে মতৈক্য নেই। এক-একজন এক-একটি কারণকে দায়ী করে থাকেন। কারো কারো মতে সিন্ধু-উপত্যকার সন্নিকটে মরুভূমি অঞ্চল থাকবার ফলে ঐ সভ্যতা টিকে থাকতে পারেনি। কারণ মরুভূমি অঞ্চল ক্রমাগত বেড়ে বেড়ে সিন্ধু-উপত্যকায় হরপ্পা সভ্যতাকে গ্রাস করেছিল। অনেকে আবার এমন কথাও বলে থাকেন যে, সিন্ধুনদীর বন্যার হাত থেকে এই সভ্যতা রেহাই পায়নি বলেই তার পতন ঘটেছিল। এই বক্তব্যের পাল্টা বক্তব্য ও অনেকে তুলে ধরেছেন। সম্প্রতি এমন কথা অনেক ঐতিহাসিক দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করেছেন যে, বহিরাগত শত্রুর আক্রমণের ফলেই হরপ্পা সভ্যতার বিনাশ হয়। এইভাবে ঐতিহাসিকদের বক্তব্য নানা খাতে বইবার ফলে কোনও স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া এখনও পর্যন্ত সম্ভব হয়নি।

প্রশ্ন : হরপ্পার অধিবাসীদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় জীবনের পরিচয় দাও।

উত্তর : 1. সূচনা :  হরপ্পা সভ্যতা খুবই উন্নত ধরনের এক নাগরিক সভ্যতা হওয়া সত্ত্বেও এই সভ্যতা সম্পর্কে আমাদের ধারণা খুবই সীমিত। কারণ হরপ্পা সভ্যতার কোনও লিখিত তথ্য পাওয়া যায়নি। তাছাড়া সিন্ধুলিপির পাঠোদ্ধার-ও করা সম্ভব হয়নি। সুতারাং পরোক্ষ উপায়ে এবং প্রাপ্ত নিদর্শনগুলির ভিত্তিতেই হরপ্পার অধিবাসীদের সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং ধর্মীয় জীবন সম্পর্কে পরিচয় পাওয়া যায়।

2. সামাজিক : হরপ্পা সভ্যতার যুগে মানুষে মানুষে ভেদাভেদের কথা নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়। তবে জাতিগত বা ধর্মগত যে প্রভেদের কথা বর্তমানেও শোনা যায় তা হরপ্পাবাসীদের মধ্যে ছিল না বলেই মনে হয়। বিত্তশালী ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি গরীব শ্রমজীবী মানুষও ছিল। বিত্তের ভিত্তিতে সমাজে ধনী এবং দরিদ্র দুটি শ্রেণী থাকলেও উভয়ের মধ্যে কোন তিক্ততা বা সংগ্রামের ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। পরবর্তী কালে আর্যদের সময়ে সমাজে যেমন নানা শ্রেণীর আবির্ভাব ঘটেছিল হরপ্পা সভ্যতার যুগে তার কোন পরিচয় পাওয়া যায়নি। নগরসমূহে বিত্তের পার্থক্য থেকে ধনী এবং দরিদ্র এই দুই সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব ছিল বলে ঐতিহাসিকদের ধারণা। ধারণার একটি কারণ হল, বড় বড় বাড়ীর পাশাপাশি ছোট ছোট ঘরের নিদর্শন। অর্থাৎ বড় দালানে থাকত ধনী সম্প্রদায়, আর ছোট ছোট প্রকোষ্ঠে থাকত শ্রমিক বা অন্যান্য শ্রমজীবীরা।

3. অর্থনৈতিক : হরপ্পা সভ্যতার যুগে মানুষের অর্থনৈতিক ভূতল থেকে যেসব নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে তা থেকে নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, কৃষি উৎপাদন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে অনেকে ব্যবসা-বাণিজ্য করেও জীবিকা নির্বাহ করতে পারত। আমলে তো আর এখনকার মতো ভারী শিল্পদ্রব্যাদি তৈরী হত না। যে কারণে দেখা যায় তামা ও ব্রোঞ্জের হাতিয়ার এবং যন্ত্রপাতি ছাড়া কৃষিপণ্য-ই ছিল ব্যবসা বাণিজ্যের প্রধান উপকরণ। গম, যব, মটর, কলাই প্রভৃতি যেমন উৎপন্ন হত প্রচুর তেমনিভাবে তুলার উৎপাদন বেশি ছিল বলেই তা থেকে সুতীবস্ত্র তৈরী করতে অসুবিধা হয়নি। ব্যবসা-বাণিজ্য যে জোর কদমে চলত তারও পরিচয় পাওয়া গিয়েছে। বিভিন্ন ঐতিহাসিক তথ্য ও নিদর্শন থেকে সকলেই স্বীকার করেছেন যে, হরপ্পার ব্যবসায়ীরা বিদেশে যাতায়াত করতেন ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে। ব্যবসা-বাণিজ্যের সূত্রে ব্যবসায়ীরা সমুদ্রপথে এশিয়ার বিভিন্ন দেশে যাতায়াত করতেন। মেসোপটেমিয়াতে হরপ্পার সিলমোহর এর মত অনেক সীলমোহর আবিষ্কৃত হয়েছে।

4. ধর্মীয় জীবন : হরপ্পাবাসীদের ধর্মীয় জীবনের পরিচয় বহন করে এমন নিদর্শন খুব বেশি পাওয়া যায়নি। এমতাবস্থায় পরোক্ষভাবে যা জানা গিয়েছে তার ভিত্তিতেই হরপ্পার ধর্মীয় জীবনের ইতিহাস রচিত। মহেঞ্জোদড়ো বা হরপ্পা নগরীতে কোনও মন্দির বা উপাসনা-গৃহের নিদর্শন পাওয়া যায়নি। তবে সীলমোহরে খোদাই করা অনেক মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে যাকে দেবী-দেবী বলে গ্রহণ করা যেতে পারে। এমনকি একটি সীলমোহরে পাওয়া গিয়েছে একজন যোগীপুরুষের মুর্তি। তিনি জীবজন্তু পরিবেষ্টিত অবস্থায় বিরাজ করছেন। তাছাড়া সেই আমলে জীবজন্তু, বৃক্ষ, সাপ প্রভৃতিরও পূজা-অর্চনা করা হত। এইভাবে হরপ্পাবাসীদের ধর্মীয় জীবন ছিল বৈচিত্র্যময়।


প্রশ্ন : হরপ্পার অধিবাসীদের সামাজিক ও ধর্মীয় জীবন সম্পর্কে কি জান ? 

উত্তর : ১. সূচনা : হরপ্পা সভ্যতার ইতিহাস পুনর্গঠন রচনা করা কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তার কারণ হল বা এই সভ্যতা সম্পর্কে আমাদের ধারণা কেবল প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনেই সীমিত। কোন লিখিত ইতিহাস হরপ্পার অধিবাসীরা রচনা করেননি । বা করলে আমাদের হাতে এসে তা পৌঁছায়নি তাছাড়া হরপ্পা সভ্যতার সীলমোহর বা সিন্ধুলিপির পাঠোদ্ধার করাও সম্ভব হয়নি। সুতরাং ইতিহাস পুনর্গঠনে একমাত্র সহায়ক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। অবশ্য আধুনিক ঐতিহাসিকদের মতে প্রত্নতত্ত্বের সাহায্যে যে সঠিক ইতিহাস পুনর্গঠন করা সম্ভব হয় তেমন আর কোন সূত্রে তা সম্ভব হয় না । ঐতিহাসিক ডি. ডি. কোশাম্বী খুবই জোরালোভাবে এই অভিমত প্রকাশ করেছেন ।

সিন্ধু বা হরপ্পা সভ্যতার যুগে সেখানকার অধিবাসীরা যেসব জিনিসপত্র দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার করত  তা থেকে তাদের সভ্যতার বিভিন্ন দিক প্রায় ছবির মত-ই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। প্রত্নতত্ত্ববিদরা প্রাপ্ত নিদর্শনগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে যেসব তথ্য সংগ্রহ করেছেন তা থেকেই সেযুগের ইতিহাস পুনর্গঠিত হয়েছে। 

২। সামাজিক জীবন :  কেবল প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের ভিত্তিতে সামাজিক ইতিহাস রচনা করা সম্ভব নয়। তবে হরপ্পা সভ্যতা অঞ্চলে প্রাপ্ত নিদর্শনের সাহায্যে প্রত্নতত্ত্ববিদ এবং ঐতিহাসিকরা হরপ্পাযুগের মানুষের সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে মোটামুটি একটা ছবি তৈরী করেছেন। হরপ্পার নগর পরিকল্পনা থেকে দেখা যায় যে সেখানে বড় বড় বাড়িগুলোর চৌহদ্দি ছিল যথেষ্ট বিস্তৃত। উঠোন এবং ঘর মিলিয়ে এক-একটা বাড়ি বেশ বড় জায়গা নিয়ে তৈরী করা হয়েছিল। আবার নগরের এক পাশে ছিল সারিবদ্ধ ছোট ছোট আস্তানা। এইসব গৃহের এলাকা খুব-ই ছোট দুটি ঘর নিয়ে এক একটি গৃহ । ঐতিহাসিকদের অনুমান বৃহৎ অট্টালিকায় বিত্তশালী মানুষ বসবাস করত, আর ছোট ছোট গৃহে বসবাস করত শ্রমিক বা মজুররা। হরপ্পা নগরীতে উঁচু প্রাচীরবেষ্টিত দুর্গ বা শস্যাগারের অস্তিত্ব যে ছিল তা ভগ্নাবশেষ থেকে স্পষ্টই বোঝা গিয়েছে। এখানকার শস্য ভাণ্ডারে যে শস্য জড়ো করা হত তা মাড়াই বা ঝাড়াইয়ের জন্য বহু শ্রমিক নিযুক্ত থাকত। শস্য ভাণ্ডারের চারপাশে ছিল এদের বসবাসের জায়গা। এইসব নিদর্শন থেকে সমাজের যে চিত্র ফুটে ওঠে তা হল, নগরবাসী বলতে বোঝাত শাসক সম্প্রদায়, পুরোহিত, ব্যবসায়ী প্রভৃতি বিত্তশালী মানুষ এবং কারিগর শ্রমিক প্রভৃতির সমষ্টি। ঐতিহাসিক রাম শরণ শর্মার মতে হরপ্পা সভ্যতার শাসকশ্রেণী মেসোপটামিয়ার মত পুরোহিত সম্প্রদায় ছিল না ।

৩। ধর্মীয় জীবন : হরপ্পা-সভ্যতাভুক্ত এলাকায় কোন দেবালয়ের নিদর্শন পাওয়া যায়নি। তা সত্ত্বেও অসংখ্য যে পুরুষ এবং নারী-মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে তা থেকে হরপ্পার অধিবাসীদের ধর্ম-ব্যবস্থা সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা করা যেতে পারে। নগ্ন নারীমূর্তির আবিষ্কার থেকে একথা মনে করা হয় যে, হরপ্পাবাসীরা উর্বরতার প্রতীক হিসাবে-ই সম্ভবত নারীমূর্তিকে দেবতাজ্ঞানে আরাধনা করত। মাতৃমূর্তির অধিকাংশই পোড়ামাটির তৈরী । হরপ্পার অর্থনীতি যে কৃষি-উৎপাদনের ওপরই নির্ভরশীল ছিল নারীমূর্তির আবিষ্কার থেকে তা স্পষ্ট বোঝা যায়।

খননকার্যের ফলে প্রাপ্ত একটি সীলমোহরে দেখা যায় যে শৃঙ্গবিশিষ্ট একজন যোগীপুরুষ উচ্চাসনে অধিষ্ঠিত এবং তাঁর চারধারে নানা জীবজন্তু। জীবজন্তু পরিবেষ্টিত এই যে যোগীপুরুষের ছবি বা ছাপ তাকে সেযুগের পুরুষ দেবতার নিদর্শন বলেই ঐতিহাসিকরা মনে করেন। পরবর্তী কালে এই দেবতাই ভারতে শিব হিসাবে পূজা পেয়েছেন। পুরুষ এবং নারীকে দেবতা হিসাবে গ্রহণ করলেও হরপ্পাবাসীরা বৃক্ষ-উপাসনা করত। তাছাড়া লিঙ্গ-উপাসনাও তাদের মধ্যে প্রচলিত ছিল।

এইভাবে বলা যেতে পারে যে, ভারতীয় হিন্দুদের মধ্যে পরবর্তী কালে যে শিব, মাতৃমূর্তি এবং লিঙ্গ -পূজা প্রচলিত হয় হরপ্পা সভ্যতার যুগেই তার সূচনা হয়েছিল।


Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.