সমাক্ষরেখা ও দ্রাঘিমারেখা | Parallels of latitude and meridians of longitude | Part-1


 

এই অধ্যায়ে আমরা সমাক্ষরেখা ও দ্রাঘিমারেখা [ Parallels of latitude and meridians of longitude] সম্পর্কে আলোচনা করব।

3.1. ভূ-পৃষ্ঠে অবস্থান নির্ণয় (Determination of Location on the Earth’s Surface) :

ভূ-পৃষ্ঠে কোনো স্থানের অবস্থান নির্ণয় করা সহজ কাজ নয়। এই উদ্দেশ্যে পৃথিবীকে গোলকরূপে কল্পনা করা হয় এবং সুবিধার জন্য ঐ গোলকের গায়ে প্রয়োজনমতো কতক গুলি  রেখাও কল্পনা করা হয়।

সাধারণত দু’টি সমকোণী নির্দিষ্ট রেখা থেকে দূরত্ব মেপে কোনো বিন্দু বা স্থানের অবস্থান  নির্ণয় করা হয়। যেমন—একটি ছক কাগজে ‘কফ’ ও ‘ফভ’ দু’টি সমকোণী রেখা এমনভাবে অঙ্কন করা হলো যে, ঐ রেখা দু’টি পরস্পরকে ‘ফ’ বিন্দুতে ছেদ করে। ‘চ’ একটি অজানা বিন্দু। ‘কফ’ ও ‘ফভ’ রেখা দুটি থেকে ‘চ’ বিন্দুর অভিলম্ব দূরত্ব চক’ ও  ‘চগ’ মেপে জানা যায়। অতএব ‘চ’ বিন্দু ‘কফ’ ও ‘ফভ’ রেখা দু’টির বিচারে কতটা পূর্বে বা উত্তরে আছে তা জানা যায়।

পৃথিবী পৃষ্ঠে অবস্থান নির্ণয় করার জন্য একটি গোলকে পূর্ব-পশ্চিম ও উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত নির্দিষ্ট দু’টি রেখা কল্পনা করা হয়। পৃথিবীকে পূর্ব-পশ্চিমে এবং উত্তর-দক্ষিণে  বেষ্টনকারী কাল্পনিক রেখা দু’টির নাম যথাক্রমে নিরক্ষরেখা বা বিষুবরেখা এবং মূল মধ্যরেখা বা গ্রীনিচরেখা। একটি গোলকে কোনো স্থান এই দু’টি রেখার কতটা উত্তর বা দক্ষিণে এবং পূর্ব বা পশ্চিমে অবস্থিত তা কৌণিক পরিমাপের সাহায্যে নিরূপণ করা যায়। প্রয়োজনে এরূপ কৌণিক পূবৰ কিমি.-তে মাপাও সম্ভব।

3.2. অক্ষাংশ (Latitude) : 

ভূ-গোলকে অবস্থিত কোনো স্থান নিরক্ষরেখা বা বিষুবরেখার সঙ্গে যে কোণ উৎপন্ন করে, তাকে ঐ স্থানের অক্ষাংশ (latitude) বলে। এরূপ কোণ বা কৌণিক দূরত্ব সব সময় ডিগ্রীতে মাপা হয়। যদি স্থানটি নিরক্ষরেখার উত্তরে অবস্থিত হয়, তবে উত্তর অক্ষাংশ এবং নিরক্ষরেখার দক্ষিণে অবস্থিত হলে দক্ষিণ অক্ষাংশ বলে। ভূ-গোলকে  অক্ষাংশ নিরক্ষরেখায় 0° থেকে মেরুদ্বয়ে ৯0° উঃ বা  দঃ  পর্যন্ত হয়। সাধারণত অক্ষাংশ ৩০° ১৫’ ২০” উঃ এভাবে লেখা হয়।

পৃথিবীর প্রকৃত আকৃতি একটি অভিগত গোলক (oblate spheroid)-এর মতো। এজন্য নিরক্ষরেখায় ১° অক্ষাংশের দৈর্ঘ্য প্রায় ১১০-৬ কিমি. কিন্তু মেরুদ্বয়ে প্রায় ১১১.৭ কিমি.। অর্থাৎ নিরক্ষরেখার তুলনায় মেরুদ্বয়ে অক্ষাংশের দৈর্ঘ্য প্রায় ১ শতাংশ বেশি।

অক্ষাংশের সাহায্যে আমরা কোনো স্থানের অবস্থান বের করতে পারি। সাধারণভাবে কোনো স্থান ০°–৩০° অক্ষাংশের মধ্যে অবস্থিত হলে নিম্ন অক্ষাংশ (low latitude), ৩০° – ৬০°র মধ্যে হলে মধ্য অক্ষাংশ (middle latitude) এবং ৬০°–১০° র মধ্যে হলে, তাকে উচ্চ অক্ষাংশ (high latitude)-এ অবস্থিত বলা হয়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় যে, কলকাতার অক্ষাংশ ২২° ৩৪’ উঃ, অর্থাৎ কলকাতা নিম্ন অক্ষাংশে অবস্থিত একটি শহর।

3.2.1. অক্ষাংশ নির্ণয় (Determination of Latitude) :

(i) নক্ষত্রের সাহায্যে– বাস্তবক্ষেত্রে অক্ষাংশ নির্ণয় করার জন্য উত্তর গোলার্ধে ধ্রুবতারা (Pole Star) এবং দক্ষিণ গোলার্ধে হ্যাডলির অকট্যান্ট  (Hadley’s Octant) নামক তারার সাহায্য নেওয়া হয়। উত্তর গোলার্ধে যে-কোনো স্থানের ওপর ধ্রুবতারার উন্নতি কোণ ঐ স্থানের অক্ষাংশ

বলে ধরা হয়। দক্ষিণ গোলার্ধেও ঠিক একই পদ্ধতিতে অবস্থান নির্ণয় করা হয়ে থাকে। 

[ii] যন্ত্রের সাহায্যে—দিগন্তরেখা থেকে কোনো নক্ষত্রের কৌণিক মাপকে ঐ নক্ষত্রের উন্নতি  বলে। সেক্সট্যান্ট (Sextant) নামক যন্ত্রের সাহায্যে সূর্যসহ যে কোনো নক্ষত্রের উন্নতি কোণ মাপ এবং স্থানটির অক্ষাংশও নির্ণয় করা সম্ভব। এছাড়া বছরের বিভিন্ন সময়ে সূর্যের উন্নতি (altitude) নৌ-সারণী (Nautical almanac) থেকেও জানা যায়। 

[iii] খুঁটির সাহায্যে-উত্তর গোলার্ধে একটি খোলা সমতল জায়গায় তিনটি খুঁটি এমনভাবে পোঁতা  হলো যে, তাদের মাথাগুলি দৃষ্টিরেখার সঙ্গে মিলিত হয়। এবার খোলা চোখে অথবা দূরবীন যাত্র সাহায্যে ঐ খুঁটিগুলির মাথা দিয়ে দিনের বেলায় সূর্য এবং রাতে ধ্রুবতারার দিকে তাকালে কৌণিক দূরত্ব পাওয়া যাবে, তা পরে কাগজে অঙ্কন করে চাদার সাহায্যে মাপলে যে কোণ হয় তা ঐ স্থানের অক্ষাংশ।

[iv] সূর্যরশ্মির পতনকোণের সাহায্যে — মধ্যাহ্নে সূর্যরশ্মির পতনকোণ মাপতে পারলে ২২শে ডিসেম্বর এবং ২১শে জুন তারিখ দু’টিতে ঠিক মধ্যাহ্নে কোনো স্থানের অক্ষাংশ নির্ণয় করা সম্ভব।    ধরা যাক, কোনো স্থানে ২২শে ডিসেম্বর মধ্যাহ্নে সূর্যরশ্মির পতনকোণ 11\frac 12^{\circ}. ঐ তারিখটিতে মধ্যাহ্নে সূর্যরশ্মি 23\frac 12^{\circ}, দঃ অক্ষাংশে ৯০° কোণে পতিত হয়। অতএব ঐ স্থানের অক্ষাংশ =90^{\circ}-\left(23\frac 12^{\circ}+11\frac 12^{\circ} \right)=55^{\circ} দঃ ; আবার ২১শে জুন কোনো স্থানে মধ্যাহ্নে সূর্যরশ্মির পতনকোণ 58\frac 12^{\circ}. ঐ তারিখটিতে সূর্যরশ্মি মধ্যাহ্নে 23\frac 12^{\circ} উঃ অক্ষাংশে 90^{\circ} কোণে পতিত হয়। অতএব ঐ স্থানের অক্ষাংশ =\left(90^{\circ}-58\frac 12^{\circ}\right)+23\frac 12^{\circ}=55^{\circ} উঃ ।

[v]  জ্যামিতিক পদ্ধতিতে – ভূ-গোলকে অক্ষাংশ নির্ণয় জ্যামিতিক পদ্ধতিতে করা হয়। পৃথিবীর ঠিক মাঝামাঝি ভূ-কেন্দ্রের ওপর দিয়ে পূর্ব-পশ্চিমে অঙ্কিত রেখাটি (ভ জ) নিরক্ষীয় তল নির্দেশ করে। এবার ভূ-পৃষ্ঠে অবস্থিত কোনো স্থানকে (খ) ভূ-কেন্দ্র (ক) পর্যন্ত সরলরেখা দিয়ে যুক্ত করা হলো। এক্ষেত্রে যে কোণটি (\angle খ ক গ = ৪০°) উৎপন্ন হবে, তা ঐ স্থানটির অক্ষাংশ। ভূ-গোলকে অক্ষরেখাগুলিকে গোলাকার অঙ্কন করা হয়। এক্ষেত্রে, প ঘ খ  ৪০° অক্ষরেখা।



3.3. অক্ষরেখা (Parallels of Latitude) :

নিরক্ষরেখা বা বিষুবরেখার উভয়দিকে সম অক্ষাংশযুক্ত পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত কাল্পনিক রেখাগুলিকে অক্ষরেখা বা সমাক্ষরেখা বলে। অক্ষরেখাগুলিকেও অক্ষাংশের মতো উঃ বা দঃ দিয়ে চিহ্নিত করা হয়। ভূ-গোলকের ঠিক মাঝখান দিয়ে অঙ্কিত নিরক্ষরেখার ব্যাস পৃথিবীর ব্যাসের সমান বলে একে মহাবৃত্ত (great circle) বলে।

একটি ভূ-গোলকে নিরক্ষরেখার উভয়দিকে ১° অন্তর মোট ৮৯টি অক্ষরেখা অঙ্কন করা যায়। কেবলমাত্র মেরুদ্বয় বিন্দু হওয়ায় কোনো অক্ষরেখায় অবস্থিত নয়। আবার ১ বা ১” অন্তরও অক্ষরেখা অঙ্কন করা সম্ভব। অক্ষরেখাগুলির সর্বোচ্চ মান ও সর্বনিম্ন মান যথাক্রমে ৯০° ও ০° ।

3.3.1. অক্ষরেখার বৈশিষ্ট্য ( Characteristics of Parallels of Latitude ) :

[i] অক্ষরেখাগুলি সর্বদাই পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে সমান্তরাল। ভূ-গোলকে যদিও এগুলিকে গোলাকার দেখায়, তথাপি এদের মধ্যে দূরত্ব সব সময়ে সমান।

[ii] অক্ষরেখাগুলি সর্বদাই প্রকৃত পূর্ব-পশ্চিম রেখা।

[iii] এদের ব্যাস নিরক্ষরেখায় সর্বাধিক এবং উত্তর ও দক্ষিণে ক্রমশ হ্রাস পায়।

(iv) এগুলি দ্রাঘিমারেখা বা দেশান্তর রেখাগুলিকে সমকোণে ছেদ করে। মেরুদ্বয় ছাড়া গোলকে অবস্থিত যে-কোনো স্থানের ক্ষেত্রেই এটা সত্য।

(v) অক্ষরেখাগুলির মধ্যে নিরক্ষরেখাই একমাত্র মহাবৃত্ত, অন্য সব রেখাই ক্ষুদ্রবৃত্ত।

(vi) একটি গোলকে অসংখ্য অক্ষরেখা অঙ্কন করা যায়। কেবলমাত্র মেরুদ্বয় ছাড়া গোলকের অন্য যে-কোনো স্থানই কোনো-না-কোনো অক্ষরেখায় অবস্থিত।

(vii) সমাক্ষরেখার সর্বোচ্চ মান ৯০°।

3.3.2. কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অক্ষরেখা (Some Important Parallels of Latitude) :

(i) নিরক্ষরেখা বা বিষুবরেখা (Equator)—পৃথিবীর মেরুদ্বয় থেকে সমান দূরত্বে ভূ-পৃষ্ঠের ওপর পূর্ব-পশ্চিমে বেষ্টনকারী কাল্পনিক রেখাটিকে নিরক্ষরেখা বলে। এর অক্ষাংশ । পৃথিবীর মধ্যভাগ বেষ্টন করে থাকায় এটি নিরক্ষবৃত্ত নামেও পরিচিত। নিরক্ষরেখা পৃথিবীকে দু’টি সমান অর্ধে বিভক্ত করেছে। এই রেখার উত্তর দিকের অর্ধাংশের নাম উত্তর গোলার্ধ (Northern hemisphere) এবং দক্ষিণ দিকের অর্ধাংশের নাম দক্ষিণ গোলার্ধ (Southern hemisphere)। যেমন ভারতবর্ষ ৮°০৪’ উঃ- ৩৭° উঃ অক্ষাংশে অবস্থিত, অর্থাৎ উত্তর গোলার্ধের একটি দেশ।

(ii) কর্কটক্রান্তি ও মকরক্রান্তি রেখা (Tropic of Cancer and Tropic of Capricorn)— নিরক্ষরেখার উত্তরে 23 \frac 12^{\circ} কৌণিক দূরত্বে অঙ্কিত কাল্পনিক রেখাটিকে কর্কটক্রান্তি  রেখা এবং দক্ষিণে 23 \frac 12^{\circ}, কৌণিক দূরত্বে অঙ্কিত রেখাটিকে মকরক্রান্তি রেখা বলে।

[iii] সুমেরু ও কুমেরু বৃত্ত (Arctic and Antarctic Circle)— নিরক্ষরেখার উত্তর দক্ষিণে 66 \frac 12^{\circ} কৌণিক দূরত্বে অঙ্কিত কাল্পনিক রেখা দু’টির নাম যথাক্রমে সুমেরু বৃত্ত এবং কুমেরু বৃত্ত।

3.3.3. অক্ষরেখার গুরুত্ব ( Importance of Parallels of Latitude):

[i] অক্ষরেখার সাহায্যে ভূ-গোলকে কোনো স্থানের অবস্থান নির্ণয় করা সম্ভব হয়। যেমন—স্থানটি নিরক্ষরেখার কতটা উত্তরে বা দক্ষিণে অবস্থিত তা জানা একমাত্র অক্ষরেখাগুলির সাহায্যেই সম্ভব। [i] অক্ষরেখাগুলি ভূ-পৃষ্ঠের কোনো স্থানের জলবায়ু, স্বাভাবিক উদ্ভিদ, মানুষের জীবনযাত্রা প্রণালী ইত্যাদি বিষয়েও ধারণা করতে সাহায্য করে। কারণ, অক্ষরেখা বা অক্ষাংশ ভেদে সূর্যরশ্মির পতনকোণের তারতম্য ঘটে এবং জলবায়ু ও অন্যান্য বৈচিত্র্যের সৃষ্টি করে।

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.