বৈদিক যুগ | Vedic Era

Vedic Era

 

১। প্রশ্ন : ঋক বেদের যুগে আর্যদের সমাজ-জীবনের পরিচয় দাও।

উত্তর : ঋক বেদের যুগে আর্যরা ভারতবর্ষে প্রবেশ করে ধীরে ধীরে পশ্চিম দিক থেকে পুর্বদিকে এগিয়ে চলেছিল। যাযাবর আর্যরা ভারতের অভ্যন্তরে যতই এগিয়ে চলেছিল ততই তাদের সমাজ-জীবনে পরিবর্তন দেখা দেয়। যাযাবরদের মধ্যে পুরুষের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। ঋকবেদের যুগে আর্যদের সমাজে তাই পুরুষরা ‘কর্তা’ হিসাবে পরিবারে সম্মান পেতেন। নারীরা গৃহকর্ত্রী হিসাবে ছিলেন সম্মানিত। বৃত্তি বা পেশার ভিত্তিতে সমাজে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র, এই চারটি ভাগ লক্ষ্য করা যায়। তবে জাতিভেদ তখনও সমাজে দেখা দেয়নি। ব্রাহ্মণরা পুরোহিতের কাজে নিয়োজিত থাকতেন এবং বিদ্যাচর্চায় পারদর্শী ছিলেন। ক্ষত্রিয়রা দেশ শাসন করতেন। বৈশ্যরা ছিলেন কৃষিজীবী। আর ‘শূদ্র’রা পরাজিত শত্রু হিসাবে প্রথম তিনটি শ্রেণীর আজ্ঞা পালন করতেন। ঋক বেদ-পরবর্তী যুগে আর্যদের সমাজ ব্যবস্থায় নানা পরিবর্তন এসেছিল। সমাজে নারীদের স্থান সাধারণভাবে উঁচুতে ছিল বলা যেতে পারে। অনেক নারী অবিবাহিত থেকে বিদ্যাভ্যাস করতেন। 

২। প্রশ্ন : বৈদিক সাহিত্য সম্পর্কে যা জান সংক্ষেপে লেখ। 

উত্তর : বৈদিক সাহিত্য এক বিশাল সাহিত্য-সম্ভার। নানা ধরনের রচনার সমষ্টি এই বৈদিক সাহিত্য। মোটামুটিভাবে বলতে গেলে বৈদিক সাহিত্য দুইভাগে বিভক্ত যথা : বেদ এবং বেদাঙ্গ। বৈদিক সাহিত্যের মধ্যে ঋক বেদ বা ঋক বেদ সংহিতা সবচেয়ে প্রাচীন। প্রতিটি বেদেরই সংহিতা আছে যথা—ঋক বেদ সংহিতা, সাম বেদ সংহিতা, যজু বেদ সংহিতা এবং অথর্ব বেদ সংহিতা। ‘সংহিতা’ মূলত গান, স্তোত্র, মন্ত্র প্রভৃতির সংকলন। সংহিতা ব্যতীত আছে ব্রাহ্মণ, আরণ্যক এবং উপনিষদ। ‘ব্রাহ্মণ’ গদ্যে রচিত এবং তাতে যাগযজ্ঞ সংক্রান্ত সাহিত্য রয়েছে। আরণ্যক অরণ্যে রচিত এক ধরনের সাহিত্য। আর ‘উপনিষদ’ অংশে বিশ্বরহস্য সমাধানের সূত্র আছে। বেদাঙ্গ বৈদিকযুগের একেবারে শেষ পর্যায়ে রচিত। বেদাঙ্গের ছয়টি ভাগ আছে যথা: শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, ছন্দ এবং জ্যোতিষ।

৩।  প্রশ্ন : বৈদিক যুগে আর্য নারীদের অবস্থা কিরূপ ছিল তা সংক্ষেপে বর্ণনা কর।

উত্তর : বৈদিক যুগকে দুইভাগে ভাগ করলে বলা যেতে পারে যে, প্রথম ভাগ, অর্থাৎ ঋগ্বেদের যুগে আর্যদের স্ত্রীরা যথেষ্ট সম্মানজনক আসনে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। সহধর্মিণী হিসাবে নারীরা স্বামীদের সঙ্গে সমানভাবে পূজা-অৰ্চনায় অংশ নিতেন। পরিবারের প্রধান পুরুষ হলেও সংসারের অন্যান্য কাজ নারীদের ই করতে হত, এবং তার মধ্যে অসম্মানের কিছু ছিল না। এমনকি ঋগ্বেদের যুগে নারীরা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করতে কোনো বাধা ছিল না। এমনকি সেযুগে নারীরা গণপরিষদে অংশগ্রহণ করতেন, এবং তার মাধ্যমে রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করতেন। কিন্তু পরবর্তী বৈদিক যুগে নারীদের সমাজিক অবস্থার অবনতি হয়। ধর্মকর্মে নারীদের অংশগ্রহণের আর কোনও সুযোগ ছিল না। গণপরিষদেও তারা আর আসন গ্রহণ করতেন না।

৪. প্রশ্ন : ঋক বেদের যুগে আর্যদের রাজনৈতিক জীবনের পরিচয় দাও।

উত্তর : ঋক বেদের যুগে আর্যরা পশুপালক থেকে ক্রমে কৃষিজীবী মানুষে রূপান্তরিত হচ্ছিল। এমতাবস্থায় তাদের সর্বাঙ্গীণ জীবনে দ্রুত পরিবর্তন লক্ষণীয়। এই পরিবর্তন থেকে রাজনৈতিক জীবন-ও বাদ পড়েনি। রাজনৈতিক দিক দিয়ে আর্যরা তখনও ছিল এক একটি গোষ্ঠীর মানুষ। রাষ্ট্র বা রাজ্য বলতে যা বোঝায় তার ধারণা ঋগ্বৈদিক আর্যদের ছিল না। তাছাড়া ‘রাজা’ বা ‘রাজন’ বলতে আর্যরা মোটেই পরবর্তী কালের শক্তিশালী রাজা বুঝত না। সে আমলে রাজা একজন গোষ্ঠীনেতার বেশি কিছু ছিলেন না। তিনি সকল ব্যাপারে গোষ্ঠী বা দলকে নেতৃত্ব দিতেন, বিশেষত যুদ্ধের সময়ে তাঁর নেতৃত্ব খুবই প্রয়োজন ছিল। সাধারণভাবে বলা যায় যে এই যে ‘রাজন’ তিনি দলের অপরাপর ব্যক্তি অপেক্ষা যে বেশি ক্ষমতা ধরতেন তা বলাই বাহুল্য। ‘রাজন’ বা গোষ্ঠীনেতা অবশ্য সকল ব্যাপারেই ‘সভা’ বা ‘সমিতির’ নির্দেশ মেনে চলতেন।

অর্থাৎ তাঁর স্বাধীনতা বহুলাংশে খর্ব করা হয়েছিল। পুরোহিত, সেনানী প্রভৃতি কর্মচারীর সাহায্য নিয়ে রাজন শাসনকাজ পরিচালনা করতেন।

৫। প্রশ্ন : ঋক বেদের যুগে আর্যদের ধর্মীয় জীবন কিরূপ ছিল?

উত্তর : ঋক বেদের যুগে আর্যরা মূলত পশুপালক ছিল বলে তাদের সমাজ যেমন ছিল পুরুষপ্রধান, তেমনি ধর্মকর্মে পুরুষদেবতাদের প্রাধান্য লক্ষণীয়। ঋক বেদের যুগে আর্যরা প্রাকৃতিক শক্তির উপাসনা করত। আকাশ, বাতাস, সূর্য প্রভৃতিকে দেবতা হিসাবে পূজা করবার রেওয়াজ ঋক বেদের যুগে প্রচলিত ছিল। সে যুগের দেবতাদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বা প্রধান ছিলেন ইন্দ্র। তিনি বজ্র বা বৃষ্টির দেবতারূপে ঐসব নিয়ন্ত্রণ করতেন। আবার শত্রু বিনাশ করতেও ইন্দ্রের প্রয়োজন ছিল। ইন্দ্র আবার নগরকে ধ্বংস করতেন বলে তাঁকে পুরন্দর বলা হত। যার অর্থ দাঁড়ায় এই যে, তিনি শত্রুদের দমনের জন্য নগরগুলো ধ্বংস করেছিলেন। ঋক বেদের যুগে আর্যরা ইহজগতের উন্নতির জন্য দেবতাদের আশীর্বাদ প্রার্থনা করত। পরবর্তী কালে আর্যদের ধর্মীয় জীবনে অনেক পরিবর্তন এসেছিল। আবার জটিলতাও বৃদ্ধি পেয়েছিল। 

৬. প্রশ্ন : সংক্ষেপে আর্যদের অর্থনৈতিক জীবন বর্ণনা কর ।

উত্তর : ঋক বেদের যুগের প্রথমে আর্যরা পশুপালক ছিল। যতই তারা ভারতবর্ষের অভ্যন্তরে পূর্বদিকে এগিয়ে যেতে থাকে ততই তারা জোর দিতে থাকে কৃষিকাজের ওপর। তারপরে এক সময় পশুপালন ছেড়ে সম্পূর্ণভাবে কৃষিজীবী হয়ে পড়ে তারা ঋক বেদের যুগে তাই আর্যরা গো-সম্পদকে খুবই মূল্যবান বলে মনে করত। কৃষিকাজ এবং সঙ্গে পশুপালন ব্যতীত অন্য কোনও বৃত্তির কথা জানা-ই যায় না। নানা ধরনের ফসল উৎপন্ন হত, যার মধ্যে আবার গম, যব প্রভৃতিই প্রধান । ঋক বেদের যুগে কৃষিকাজ প্রধান হয়ে উঠলেও কৃষিজমি কারো ব্যক্তিগত অধিকারে ছিল না। অর্থাৎ বর্তমানে জমি যেমন ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসাবে বিবেচিত হয়, সেযুগে তা ছিল না। বরঞ্চ সম্পদ হিসাবে গরু এবং ক্রীতদাসীর কথা-ই জানা যায়।

ঋক বেদের যুগে কৃষিকাজ ছাড়া অপরাপর যেসব বৃত্তি বা পেশার কথা জানা যায় তার মধ্যে বয়নশিল্প, দারুশিল্প, মৃৎশিল্প, চর্মশিল্প প্রধান। তবে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রচলন থাকলেও তা তেমনভাবে চলত বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন না ঋক বেদে ‘সমুদ্র' কথাটির উল্লেখ থাকলেও সমুদ্রপথে ব্যবসায়ীরা যাতায়াত করতেন এমন প্রমাণ নেই। ঋক বেদের যুগে আর্যরা নগরে বসবাস করত না। গ্রামজীবনেই তারা অভ্যস্ত ছিল।

রাজনৈতিক জীবনে যেমন পরবর্তী বৈদিক যুগে নানা পরিবর্তন দেখা দিয়েছিল তেমনি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক অদল-বদল লক্ষ্য করা যায়। পরবর্তী বৈদিক যুগে নগর গড়ে উঠতে থাকে। নতুন নতুন পেশার সৃষ্টি হয়, ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিমাণও আগেকার তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পায়। পরবর্তী বৈদিক যুগে লৌহের ব্যাপক প্রচলন ঘটায় নানা ধরনের যন্ত্রপাতি, হাতিয়ার প্রভৃতি তৈরী হতে থাকে, এবং এইসব পণ্যসামগ্রী ব্যবসা-বাণিজ্যের উপকরণ হয়ে ওঠে। নানা প্রকার মৃৎপাত্র এগে তৈরী হত। কৃষিকাজ ব্যাপকভাবে চলতে থাকে। চাল-গম প্রভৃতির উৎপাদন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছিল। এইভাবে ঋক বেদ এবং ঋক বেদ-পরবর্তী আমলে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছিল আর্যদের অর্থনৈতিক জীবনে।

৭. প্রশ্ন : ‘চতুরাশ্রম’ বলতে কি বোঝ?

উত্তর : ‘চতুরাশ্রম’ বলতে আর্যদের ইহলৌকিক জীবনযাত্রার চারটি ধাপ বোঝায়। চতুরাশ্রম বা চারটি আশ্রমে জীবনকে ভাগ করবার যে পদ্ধতি তা ঋগ্বেদ বা প্রাচীন বৈদিক যুগে প্রচলিত ছিল না। পরবর্তী বৈদিক যুগে যখন আর্যদের সমাজ ব্যবস্থা জটিল হয়ে ওঠে, ধর্মকর্মে জটিলতা দেখা দেয় একমাত্র তখনই চতুরাশ্রম প্রথা প্রচলিত হয়েছিল। এই ব্যবস্থা অনুসারে আর্যদের মধ্যে যাঁরা ‘দ্বিজ’, অর্থাৎ দুইবার জন্মগ্রহণ  করেন তাঁরা চতুরাশ্রমের মধ্যে দিয়ে জীবনযাপন করবেন। চারটি আশ্রমের মধ্যে প্রথম হল, ‘ব্রহ্মচর্য' যেখানে আর্যপুরুষ শুরুগৃহে থেকে বিদ্যাভ্যাস করবেন। দ্বিতীয় আশ্রম 'গার্হস্থ্য' যে সময়ে আর্যপুরুষ বিবাহ করে সংসার ধর্ম পালন করেন। তৃতীয় আশ্রম ‘বানপ্রস্থ তৈ আর্যরা সংসার পরিত্যাগ করে নিভৃতে কাটাবেন। আর চতুর্থ বা সর্বশেষ আশ্রম 'সন্ন্যাস'-এ আর্যরা সন্ন্যাসীর মত জীবনযাপন করবেন।

৮ । প্রশ্ন : আর্যদের জাতিভেদ বা বর্ণভেদ প্রথা সম্পর্কে সংক্ষেপে যা জান লেখ। 

উত্তর : জাতিভেদ বা বর্ণভেদ প্রথা আজকের দিনে যত খারাপই হোক না কেন তার উৎস কিন্তু অন্যরকমভাবে হয়েছিল। আর তাতে অনিষ্টকর কিছু ছিল না। ঋগ্বেদের যুগে আর্যরা ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র, এই চারভাগে যে বিভক্ত ছিল তাতে জাতপাতের ব্যাপার কিন্তু ছিল না। এই বিভাগ ছিল বৃত্তিমূলক। অর্থাৎ ব্রাহ্মণরা শিক্ষাদীক্ষা এবং পূজা-অর্চনার কাজে লিপ্ত থাকতেন, ক্ষত্রিয়রা দেশ শাসনের কাজে, বৈশ্যরা ব্যবসা-বাণিজ্য এবং কৃষিকাজ করতেন। শূদ্রদের অবস্থা কিন্তু ছিল তুলনামূলকভাবে নীচুতে। কারণ তারা আর্যদের দ্বারা বিজিত মানুষ। তবে সমাজে তাদের অচ্ছ্যুত করে রাখা হয়নি। কিন্তু পরবর্তী বৈদিক যুগে এই বৃত্তিমূলক ভাগ জন্মগত হয়ে দেখা দিয়েছিল। একজন ব্রাহ্মণের সস্তান-ই কেবল ব্রাহ্মণ হতে পারবে। অন্য কেউ তা হতে পারবে না, আবার শুদ্রের সস্তান শুদ্র-ই থাকবে এইভাবে জাতিভেদ একটা সামাজিক ব্যাধির মতো হয়ে উঠতে শুরু করেছিল।

৯. প্রশ্ন : আর্যদের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক জীবন সম্পর্কে যা জান বুঝিয়ে বল।

উত্তর : ক.ব্রাজনৈতিক : আর্যদের রাজনৈতিক জীবনে বৈদিক এবং পরবর্তী বৈদিক যুগে অনেক পরিবর্তন ঘটেছিল। ঋগ্বেদের যুগে আর্যরা যখন দলবদ্ধভাবে বসবাস করত তখন তাদের কোনও দেশ বা রাজ্য বলতে কিছু ছিল না। এক একটা জায়গায় দলবদ্ধভাবে আর্যরা বসবাস করত। আর দলপতি তাদের নেতৃত্ব দিতেন। এই দলপতি কিন্তু রাজা নন। তিনি নিশ্চয় ই ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। তবে তাঁকে গণপরিষদের মতামত মেনেই চলতে হত। ‘সভা’ এবং ‘সমিতি' নামে দুটি গণপরিষদের নাম ঋগ্বেদে পাওয়া যায়। ‘সভা’ ছিল বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তিদের সভা, আর ‘সমিতি’তে গণ্যমান্য ব্যক্তিরা আসন গ্রহণ করতেন।

রাজার প্রধান কাজ ছিল গোষ্ঠী বা দল, যার তিনি নেতৃত্ব করছেন তার নিরাপত্তাকে নিশ্চিত করা। যাতে অপর কোনও দল বা গোষ্ঠীর লোক এই দলের ক্ষতি করতে না পারে। দলপতি কোথায় আক্রমণ চালাবেন, বা আদৌ তা করবেন কিনা সে বিষয়ে সভা ও সমিতির সকলে তাঁকে নির্দেশ দিতেন। রাজা, অর্থাৎ দলপতি, তা পালন করতেন। দলের মধ্যে শৃঙ্খলা বজায় রাখা বা সেখানে একটি প্রশাসন গড়ে তোলবার জন্য যে অর্থব্যয় হত তা আসত রাজাকে দেওয়া উপহার থেকে। 

ঋগ্বেদের যুগের শেষদিকে, বিশেষত পরবর্তী বৈদিক যুগে, অবশ্য এই অবস্থার অনেক পরিবর্তন ঘটেছিল। রাজার ক্ষমতা আগেকার তুলনায় বেড়ে গিয়েছিল। আগেকার মতো আর রাজাকে সভা-সমিতির কথা মেনে চলতে হত না। তিনি নিজেই সকল ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতেন। অন্যেরা সকলেই তার কথা মেনে চলত।

খ. অর্থনৈতিক : ঋগ্বেদের যুগের প্রথমে আর্যরা পশুপালক ছিল। যতই তারা ভারতবর্ষের অভ্যন্তরে পূর্বদিকে এগিয়ে যেতে থাকে ততই তারা জোর দিতে থাকে কৃষিকাজের ওপর। তারপরে এক সময় পশুপালন ছেড়ে সম্পূর্ণভাবে কৃষিজীবী হয়ে পড়ে তারা। ঋগ্বেদের যুগে তাই আর্যরা গো-সম্পদকে খুবই মূল্যবান বলে মনে করত। কৃষিকাজ এবং সঙ্গে পশুপালন ব্যতীত অন্য কোনও বৃত্তির কথা জানা যায় না। নানা ধরনের ফসল উৎপন্ন হত, যার মধ্যে আবার গম, যব প্রভৃতিই প্রধান। ঋগ্বেদের যুগে কৃষিকাজ প্রধান হয়ে উঠলেও কৃষিজমি কারো ব্যক্তিগত অধিকারে ছিল না। অর্থাৎ বর্তমানে জমি যেমন ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসাবে বিবেচিত হয়, সেযুগে তা ছিল না। বরঞ্চ সম্পদ হিসাবে গরু এবং ক্রীতদাসীর কথা জানা যায়।

ঋগ্বেদের যুগে কৃষিকাজ ছাড়া অপরাপর যেসব বৃত্তি বা পেশার কথা জানা যায় তার মধ্যে বয়নশিল্প, দারুশিল্প, মৃৎশিল্প, চর্মশিল্প প্রধান। তবে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রচলন থাকলেও তা তেমনভাবে চলত বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন না। ঋগ্বেদে ‘সমুদ্র’ কথাটির উল্লেখ থাকলেও সমুদ্রপথে ব্যবসায়ীরা যাতায়াত করতেন এমন প্রমাণ নেই। ঋগ্বেদের যুগে আর্যরা নগরে বসবাস করত না। গ্রামজীবনেই তারা অভ্যস্ত
ছিল।

রাজনৈতিক জীবনে যেমন পরবর্তী বৈদিক যুগে নানা পরিবর্তন দেখা দিয়েছিল তেমনি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক অদল-বদল লক্ষ্য করা যায়। পরবর্তী বৈদিক যুগে নগর গড়ে উঠতে থাকে। নতুন নতুন পেশার সৃষ্টি হয়, ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিমাণও আগেকার তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পায়। পরবর্তী বৈদিক যুগে লৌহের ব্যাপক প্রচলন ঘটায় নানা ধরনের যন্ত্রপাতি, হাতিয়ার প্রভৃতি তৈরী হতে থাকে, এবং এইসব পণ্যসামগ্রী ব্যবসা-বাণিজ্যের উপকরণ হয়ে ওঠে। নানা প্রকার মৃৎপাত্র এযুগে তৈরী হত। কৃষিকাজ ব্যাপকভাবে চলতে থাকে। চাল-গম প্রভৃতির উৎপাদন অনেক বৃদ্ধি পেয়েছিল। এইভাবে ঋগ্বেদ এবং ঋগ্বেদ পরবর্তী আমলে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছিল আর্যদের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় । 

 ১০. প্রশ্ন : ঋক বেদের যুগের আর্যদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবন বর্ণনা কর। 

উত্তর : আর্যদের সম্পর্কে জানতে হলে আমাদের নির্ভর করতে হয় বৈদিক সাহিত্যের ওপর। আর প্রথম যুগের আর্যদের কথা জানা যায় বৈদিক সাহিত্যের প্রাচীনতম অংশ ঋক বেদ থেকে। ভারতবর্ষে আর্যরা প্রবেশের পরে অনেকদিন পর্যন্ত তাদের পেশা ছিল পশুপালন। পশুপালক সমাজে যেমন পুরুষদের প্রাধান্য থাকে তেমনিভাবে আর্যদের সমাজ-ও ছিল পিতৃতান্ত্রিক। তবে নারীদেরও সমাজে উঁচু আসন ছিল। তাঁরা গৃহকর্তার সঙ্গে ধর্মকর্মে অংশ নিতেন। বৃত্ত বা পেশার ভিত্তিতে সমাজ চারটি ভাগে বিভক্ত ছিল। যথা: ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শুদ্র। তবে এই বিভাগকে জাতিভেদ বলা চলে না। কারণ ঋক বেদের যুগে এক পেশার মানুষ অপর পেশা গ্রহণ করতে পারত। অর্থাৎ একজন ব্রাহ্মণ অনায়াসে বৈশ্য হতে পারত। ব্রাহ্মণরা পুরোহিতের কাজ করত এবং বিদ্যাচর্চায় পারদর্শী ছিল। ক্ষত্রিয়রা দেশ শাসন এবং যুদ্ধবিগ্রহ করত পারদর্শিতার সঙ্গে। শূদ্ররা কৃষিকাজে অভ্যস্ত ছিল। ঋক বেদের পরবর্তী কালে আর্যদের সমাজ ব্যবস্থায় নানা পরিবর্তন এসেছিল। 
ঋকবেদের যুগে আর্যরা পশুপালক হিসাবে-ই বেশি সময় আর্যদের অর্থনৈ কাটাত। ধীরে ধীরে তারা অবশ্য কৃষিকার্যে মন নিবেশ করে। 
তারপরে এক সময় তারা সম্পূর্ণভাবে কৃষিজীবী হয়ে উঠেছিল। ঋক বেদের যুগের শেষভাগে, তাই দেখা যায় আর্যদের অর্থনৈতিক জীবনে কৃষিকাজ মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর পশুপালন গৌণ। তাসত্ত্বেও তখন গোসম্পদ প্রধান সম্পদ বলে বিবেচিত হত। ঋগ্বেদের যুগে পশুপালন অর্থনীতির প্রধান ভিত্তি ছিল বলে চমশিল্প গড়ে ওঠার সুযোগ অনেকটাই ছিল। তাছাড়া ছুতোরের কাজ করেও অনেকে জীবিকা নির্বাহ করতে অভ্যস্ত ছিল। রথের ব্যবহার ব্যাপক হারে প্রচলিত ছিল বলে দারুশিল্প জনপ্রিয় শিল্প হয়ে উঠেছিল। 

বস্ত্রশিল্প বা বয়নশিল্প ঋক বেদের যুগে প্রচলিত ছিল। এই শিল্পে নিযুক্ত ব্যক্তিরা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিলেন। কাপড় তৈরীর জন্য কি বস্তু ব্যবহার করা হত তা সঠিকভাবে জানা যায়নি। তবে ঋগ্বেদে ‘মেষলোমষ' কথাটির উল্লেখ থাকায় তা থেকে বস্ত্র তৈরীর কথাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ঋক বেদের যুগে ব্যবসা-বাণিজ্য প্রচলিত থাকলেও সাগর পাড়ি দিয়ে ব্যবসায়ীরা বিদেশে যাতায়াত করতেন বলে জানা যায় না। সবেশেষে বলা যেতে পারে যে, ঋগ্বেদে যে অর্থনীতির পরিচয় পাওয়া যায় তাকে সর্বভারতীয় বলা যায় না। দেশের এক এক জায়গায় অর্থাৎ আর্যবসতির ভিন্ন ভিন্ন জায়গায়, অর্থনৈতিক চিত্র এক এক রকম ছিল।



Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.