১। প্রশ্ন : ঋক বেদের যুগে আর্যদের সমাজ-জীবনের পরিচয় দাও।
উত্তর : ঋক বেদের যুগে আর্যরা ভারতবর্ষে প্রবেশ করে ধীরে ধীরে পশ্চিম দিক থেকে পুর্বদিকে এগিয়ে চলেছিল। যাযাবর আর্যরা ভারতের অভ্যন্তরে যতই এগিয়ে চলেছিল ততই তাদের সমাজ-জীবনে পরিবর্তন দেখা দেয়। যাযাবরদের মধ্যে পুরুষের প্রাধান্য লক্ষ্য করা যায়। ঋকবেদের যুগে আর্যদের সমাজে তাই পুরুষরা ‘কর্তা’ হিসাবে পরিবারে সম্মান পেতেন। নারীরা গৃহকর্ত্রী হিসাবে ছিলেন সম্মানিত। বৃত্তি বা পেশার ভিত্তিতে সমাজে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র, এই চারটি ভাগ লক্ষ্য করা যায়। তবে জাতিভেদ তখনও সমাজে দেখা দেয়নি। ব্রাহ্মণরা পুরোহিতের কাজে নিয়োজিত থাকতেন এবং বিদ্যাচর্চায় পারদর্শী ছিলেন। ক্ষত্রিয়রা দেশ শাসন করতেন। বৈশ্যরা ছিলেন কৃষিজীবী। আর ‘শূদ্র’রা পরাজিত শত্রু হিসাবে প্রথম তিনটি শ্রেণীর আজ্ঞা পালন করতেন। ঋক বেদ-পরবর্তী যুগে আর্যদের সমাজ ব্যবস্থায় নানা পরিবর্তন এসেছিল। সমাজে নারীদের স্থান সাধারণভাবে উঁচুতে ছিল বলা যেতে পারে। অনেক নারী অবিবাহিত থেকে বিদ্যাভ্যাস করতেন।
২। প্রশ্ন : বৈদিক সাহিত্য সম্পর্কে যা জান সংক্ষেপে লেখ।
উত্তর : বৈদিক সাহিত্য এক বিশাল সাহিত্য-সম্ভার। নানা ধরনের রচনার সমষ্টি এই বৈদিক সাহিত্য। মোটামুটিভাবে বলতে গেলে বৈদিক সাহিত্য দুইভাগে বিভক্ত যথা : বেদ এবং বেদাঙ্গ। বৈদিক সাহিত্যের মধ্যে ঋক বেদ বা ঋক বেদ সংহিতা সবচেয়ে প্রাচীন। প্রতিটি বেদেরই সংহিতা আছে যথা—ঋক বেদ সংহিতা, সাম বেদ সংহিতা, যজু বেদ সংহিতা এবং অথর্ব বেদ সংহিতা। ‘সংহিতা’ মূলত গান, স্তোত্র, মন্ত্র প্রভৃতির সংকলন। সংহিতা ব্যতীত আছে ব্রাহ্মণ, আরণ্যক এবং উপনিষদ। ‘ব্রাহ্মণ’ গদ্যে রচিত এবং তাতে যাগযজ্ঞ সংক্রান্ত সাহিত্য রয়েছে। আরণ্যক অরণ্যে রচিত এক ধরনের সাহিত্য। আর ‘উপনিষদ’ অংশে বিশ্বরহস্য সমাধানের সূত্র আছে। বেদাঙ্গ বৈদিকযুগের একেবারে শেষ পর্যায়ে রচিত। বেদাঙ্গের ছয়টি ভাগ আছে যথা: শিক্ষা, কল্প, ব্যাকরণ, ছন্দ এবং জ্যোতিষ।
৩। প্রশ্ন : বৈদিক যুগে আর্য নারীদের অবস্থা কিরূপ ছিল তা সংক্ষেপে বর্ণনা কর।
উত্তর : বৈদিক যুগকে দুইভাগে ভাগ করলে বলা যেতে পারে যে, প্রথম ভাগ, অর্থাৎ ঋগ্বেদের যুগে আর্যদের স্ত্রীরা যথেষ্ট সম্মানজনক আসনে প্রতিষ্ঠিত ছিলেন। সহধর্মিণী হিসাবে নারীরা স্বামীদের সঙ্গে সমানভাবে পূজা-অৰ্চনায় অংশ নিতেন। পরিবারের প্রধান পুরুষ হলেও সংসারের অন্যান্য কাজ নারীদের ই করতে হত, এবং তার মধ্যে অসম্মানের কিছু ছিল না। এমনকি ঋগ্বেদের যুগে নারীরা উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করতে কোনো বাধা ছিল না। এমনকি সেযুগে নারীরা গণপরিষদে অংশগ্রহণ করতেন, এবং তার মাধ্যমে রাজনৈতিক দায়িত্ব পালন করতেন। কিন্তু পরবর্তী বৈদিক যুগে নারীদের সমাজিক অবস্থার অবনতি হয়। ধর্মকর্মে নারীদের অংশগ্রহণের আর কোনও সুযোগ ছিল না। গণপরিষদেও তারা আর আসন গ্রহণ করতেন না।
৪. প্রশ্ন : ঋক বেদের যুগে আর্যদের রাজনৈতিক জীবনের পরিচয় দাও।
উত্তর : ঋক বেদের যুগে আর্যরা পশুপালক থেকে ক্রমে কৃষিজীবী মানুষে রূপান্তরিত হচ্ছিল। এমতাবস্থায় তাদের সর্বাঙ্গীণ জীবনে দ্রুত পরিবর্তন লক্ষণীয়। এই পরিবর্তন থেকে রাজনৈতিক জীবন-ও বাদ পড়েনি। রাজনৈতিক দিক দিয়ে আর্যরা তখনও ছিল এক একটি গোষ্ঠীর মানুষ। রাষ্ট্র বা রাজ্য বলতে যা বোঝায় তার ধারণা ঋগ্বৈদিক আর্যদের ছিল না। তাছাড়া ‘রাজা’ বা ‘রাজন’ বলতে আর্যরা মোটেই পরবর্তী কালের শক্তিশালী রাজা বুঝত না। সে আমলে রাজা একজন গোষ্ঠীনেতার বেশি কিছু ছিলেন না। তিনি সকল ব্যাপারে গোষ্ঠী বা দলকে নেতৃত্ব দিতেন, বিশেষত যুদ্ধের সময়ে তাঁর নেতৃত্ব খুবই প্রয়োজন ছিল। সাধারণভাবে বলা যায় যে এই যে ‘রাজন’ তিনি দলের অপরাপর ব্যক্তি অপেক্ষা যে বেশি ক্ষমতা ধরতেন তা বলাই বাহুল্য। ‘রাজন’ বা গোষ্ঠীনেতা অবশ্য সকল ব্যাপারেই ‘সভা’ বা ‘সমিতির’ নির্দেশ মেনে চলতেন।
অর্থাৎ তাঁর স্বাধীনতা বহুলাংশে খর্ব করা হয়েছিল। পুরোহিত, সেনানী প্রভৃতি কর্মচারীর সাহায্য নিয়ে রাজন শাসনকাজ পরিচালনা করতেন।
৫। প্রশ্ন : ঋক বেদের যুগে আর্যদের ধর্মীয় জীবন কিরূপ ছিল?
উত্তর : ঋক বেদের যুগে আর্যরা মূলত পশুপালক ছিল বলে তাদের সমাজ যেমন ছিল পুরুষপ্রধান, তেমনি ধর্মকর্মে পুরুষদেবতাদের প্রাধান্য লক্ষণীয়। ঋক বেদের যুগে আর্যরা প্রাকৃতিক শক্তির উপাসনা করত। আকাশ, বাতাস, সূর্য প্রভৃতিকে দেবতা হিসাবে পূজা করবার রেওয়াজ ঋক বেদের যুগে প্রচলিত ছিল। সে যুগের দেবতাদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বা প্রধান ছিলেন ইন্দ্র। তিনি বজ্র বা বৃষ্টির দেবতারূপে ঐসব নিয়ন্ত্রণ করতেন। আবার শত্রু বিনাশ করতেও ইন্দ্রের প্রয়োজন ছিল। ইন্দ্র আবার নগরকে ধ্বংস করতেন বলে তাঁকে পুরন্দর বলা হত। যার অর্থ দাঁড়ায় এই যে, তিনি শত্রুদের দমনের জন্য নগরগুলো ধ্বংস করেছিলেন। ঋক বেদের যুগে আর্যরা ইহজগতের উন্নতির জন্য দেবতাদের আশীর্বাদ প্রার্থনা করত। পরবর্তী কালে আর্যদের ধর্মীয় জীবনে অনেক পরিবর্তন এসেছিল। আবার জটিলতাও বৃদ্ধি পেয়েছিল।
৬. প্রশ্ন : সংক্ষেপে আর্যদের অর্থনৈতিক জীবন বর্ণনা কর ।
উত্তর : ঋক বেদের যুগের প্রথমে আর্যরা পশুপালক ছিল। যতই তারা ভারতবর্ষের অভ্যন্তরে পূর্বদিকে এগিয়ে যেতে থাকে ততই তারা জোর দিতে থাকে কৃষিকাজের ওপর। তারপরে এক সময় পশুপালন ছেড়ে সম্পূর্ণভাবে কৃষিজীবী হয়ে পড়ে তারা ঋক বেদের যুগে তাই আর্যরা গো-সম্পদকে খুবই মূল্যবান বলে মনে করত। কৃষিকাজ এবং সঙ্গে পশুপালন ব্যতীত অন্য কোনও বৃত্তির কথা জানা-ই যায় না। নানা ধরনের ফসল উৎপন্ন হত, যার মধ্যে আবার গম, যব প্রভৃতিই প্রধান । ঋক বেদের যুগে কৃষিকাজ প্রধান হয়ে উঠলেও কৃষিজমি কারো ব্যক্তিগত অধিকারে ছিল না। অর্থাৎ বর্তমানে জমি যেমন ব্যক্তিগত সম্পত্তি হিসাবে বিবেচিত হয়, সেযুগে তা ছিল না। বরঞ্চ সম্পদ হিসাবে গরু এবং ক্রীতদাসীর কথা-ই জানা যায়।
ঋক বেদের যুগে কৃষিকাজ ছাড়া অপরাপর যেসব বৃত্তি বা পেশার কথা জানা যায় তার মধ্যে বয়নশিল্প, দারুশিল্প, মৃৎশিল্প, চর্মশিল্প প্রধান। তবে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রচলন থাকলেও তা তেমনভাবে চলত বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন না ঋক বেদে ‘সমুদ্র' কথাটির উল্লেখ থাকলেও সমুদ্রপথে ব্যবসায়ীরা যাতায়াত করতেন এমন প্রমাণ নেই। ঋক বেদের যুগে আর্যরা নগরে বসবাস করত না। গ্রামজীবনেই তারা অভ্যস্ত ছিল।