ভারতে সভ্যতার উদয় (PART-2)

ভারতে সভ্যতার উদয় (PART-2)

  

প্রশ্ন : হরপ্পা বা সিন্ধু সভ্যতা এবং আর্য সভ্যতার মধ্যে কি কি মৌলিক পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় ?

উত্তর : 1. সূচনা : হরপ্পা সভ্যতা এবং আর্য সভ্যতা উভয়েই ভারতের মাটিতে বিকশিত হলেও তাদের মধ্যে অমিল অনেক। অর্থাৎ দুইয়ের মধ্যে মিল খুব সামান্য।

2. প্রথমত, হরপ্পা সভ্যতা আর্যদের ভারতবর্ষে উপনীত হবার অনেক আগে শুরু হয়েছে। হরপ্পা সভ্যতার সূচনা, এবং আর্যদের ভারত আগমনের সময় নির্ণয় করলে দেখা যাবে দুইয়ের মধ্যে হাজার বছরেরই দূরত্ব।

3. দ্বিতীয়ত, আর্যরা প্রথমদিকে ছিল গোপালক। অর্থাৎ কৃষিকাজের পরিবর্তে পশুপালনকেই তারা জীবিকা হিসাবে গ্রহণ করেছিল। পরবর্তী কালে তারা কৃষিজীবী হয়ে ওঠে। কিন্তু হরপ্পাবাসীরা আধুনিক যুগের মতো কৃষিকাজ এবং ব্যবসা-বাণিজ্যকে জীবিকা হিসাবে গ্রহণ করেছিল।

4. তৃতীয়ত, হরপ্পা সভ্যতার যেসব নগরকেন্দ্র আবিষ্কৃত হয়েছে তা থেকে একথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে, সেখানকার মানুষ ছিল নগরবাসী। অর্থাৎ নাগরিক জীবনের সুখ-স্বচ্ছন্দ্য ভোগ করাই ছিল হরপ্পাবাসীদের বৈশিষ্ট্য। অপরদিকে আর্যরা ছিল কৃষিজীবী ও পশুপালক। কেবল তাই নয়, তারা নগর ধ্বংস করত। আর্যদের দেবতা ইন্দ্রের অপর নাম ছিল ‘পুরন্দর’, অর্থাৎ যিনি নগর ধ্বংস করেন। 

5. চতুর্থত, দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত খাদ্য দ্রব্যের মধ্যেও হরপ্পাবাসী এবং আর্যদের মধ্যে পার্থক্য লক্ষণীয়। আর্যরা মাংস ভক্ষনের পক্ষপাতী ছিল। অতিথিদের আপ্যায়ন করার প্রধান উপকরণ ছিল মাংস। বেদের ছত্রে ছত্রে তাই গো-মাংস, অশ্ব, মহিষ প্রভৃতি মাংসের ব্যবহারের উল্লেখ পাওয়া যায়। কিন্তু সিন্ধু-উপত্যকার মানুষ মাংস ভক্ষনে ততটা আগ্রহী ছিল বলে জানা যায় না। হরপ্পাবাসী প্রধানতঃ মৎস্যভোজী ছিল। আর্যরা মৎস্য ভক্ষন করত না।

6. পঞ্চমত, আর্যদের যেসব জীবজন্তুর সঙ্গে পরিচয় ছিল হরপ্পাবাসীদের তার সঙ্গে পরিচয় ছিল না। সিন্ধু-সভ্যতার মানুষ হাতির সঙ্গে সুপরিচিত ছিল। কিন্তু আর্যরা হাতির সঙ্গে পরিচিত ছিল না। এইভাবে বলা যেতে পারে যে, আর্যদের সঙ্গে হরপ্পা সভ্যতার মানুষের নানা বিষয়ে পার্থক্য বা অমিল ছিল। ক্রমে ভারতবর্ষে দীর্ঘদিন বসবাসের ফলে সেই পার্থক্য কমতে থাকে। সুতরাং যাঁরা হরপ্পা সভ্যতা এবং বৈদিক আর্য-সভ্যতাকে এক করে দেখবার পক্ষপাতী তাদের বক্তব্যের অসারতা এমনিতেই প্রমাণিত হয়।

প্রশ্ন : হরপ্পা সভ্যতার উপর একটি প্রবন্ধ রচনা কর।  অথবা  সিন্ধু-সভ্যতার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।

উত্তর : ক. সূচনা : হরপ্পা-সভ্যতা বর্তমান শতকে আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্যের ফলে বর্তমান শতকের গোড়ার দিকে সিন্ধু নদীর উপত্যকার বিভিন্ন অঞ্চলে প্রাচীন হরপ্পা-সভ্যতার নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে। এই আবিষ্কার ভারতীয় সভ্যতার দিক থেকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তা প্রমাণ করেছে যে, ভারতীয় সভ্যতা বিশ্বের প্রাচীনতম সভ্যতাগুলির অন্যতম। অর্থাৎ পৃথিবীর অল্প যেকটি কেন্দ্রে প্রাচীন সভ্যতার উদয় ঘটেছিল ভারত তাদের অন্যতম।

খ. সুপ্রাচীন সভ্যতা হরপ্পা-সভ্যতার সময়কাল নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতভেদ থাকলেও সাধারণভাবে স্বীকৃত মত হল এই যে, খ্রীস্টপূর্ব ২৩০০ থেকে ১৭৫০ অব্দের মধ্যে হরপ্পা-সভ্যতা টিকেছিল। 

হরপ্পা সভ্যতা কারা সৃষ্টি করেছিল তা নিয়েও ঐতিহাসিকরা একমত নন। তবে সকলেই প্রায় মেনে নিয়েছেন যে, হরপ্পা সভ্যতা ভারতীয়দেরই সৃষ্টি। কেবল প্রাচীনতা এবং সৃষ্টির দিক থেকেই নয়, বিস্তৃতির দিক দিয়েও হরপ্পা সংস্কৃতি এক বিশাল অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। তার পরিধি মোটেই সিন্ধু উপত্যকা অঞ্চলে সীমিত ছিল না। ভারতের উত্তর এবং দক্ষিণে এর বিস্তৃতি ছিল এক হাজার কিলোমিটার-এরও বেশি।

গ. জানবার উপায় : হরপ্পা সভ্যতা সম্পর্কে আমাদের ধারণা খুবই সীমিত। কারণ এই সভ্যতা সম্পর্কে লিখিত কোনও তথ্য পাওয়া যায়নি। হরপ্পা সভ্যতার বিভিন্ন অঞ্চলে যে নানা নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে সেই সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই প্রত্নতত্ত্ববিদরা সভ্যতার ইতিহাস রচনা করেছেন। এই প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে যে, সিন্ধু-লিপির পাঠোদ্ধার এখনও পর্যন্ত সম্ভব না হওয়ায় সিন্ধু উপত্যকায় হরপ্পা সভ্যতার অনেক কিছু জানা যায়নি। ভবিষ্যতে তা সম্ভব হলে হরপ্পা সভ্যতা সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান সম্পূর্ণ হবে।

ঘ. নাগরিক সভ্যতা : হরপ্পা সভ্যতার বৈশিষ্ট্যগুলি আলোচনা করলে দেখা যাবে যে, এই সভ্যতার অনেক কিছুর সঙ্গেই বর্তমান সভ্যতার মিল রয়েছে। প্রথমত, হরপ্পা সভ্যতা একটি নগরভিত্তিক সভ্যতা। নগর জীবনের যাবতীয় সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, সুযোগ-সুবিধা হরপ্পাবাসীরা ভোগ করতেন। হরপ্পার বিভিন্ন শহরের  যে নগর-পরিকল্পনা তা থেকেও নাগরিক সভ্যতার ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। দ্বিতীয়ত, হরপ্পা, মহেঞ্জোদড়ো প্রভৃতি শহরের যে পরিকল্পনা তা আজও মানুষের বিস্ময় উৎপন্ন করে। হরপ্পা সভ্যতার নগরগুলো নগরবাসীদের স্বাস্থ্য এবং অপরাপর সুযোগ-সুবিধার দিকে নজর দিয়েই তৈরী করা হয়েছিল। স্নানাগার ব্যতীত শস্যাগার, জলনিকাশী নর্দমা প্রভৃতি আধুনিক শহরের বৈশিষ্ট্য। হরপ্পা, মহেঞ্জোদড়ো প্রভৃতি জায়গা তার নিদর্শন-ই বহন করে।

ঙ. অর্থনৈতিক অবস্থা : প্রথমত, হরপ্পা সভ্যতার মানুষের অর্থনীতিতেও নগর জীবনের পরিচয় পাওয়া যায়। যে কোনও বর্তমান শহরের মতোই কৃষিকাজ হত গ্রামাঞ্চলে। সেখান থেকে ফসল এনে জড়ো করা হত শহরের শস্যাগারে। নানা ধরনের ধাতু প্রচলিত ছিল বলে ধাতুবিদ্যাকে অনেকেই পেশা হিসাবে গ্রহণ করেছিল। দ্বিতীয়ত, হরপ্পা সভ্যতার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য এবং ব্যবসায়ী সম্প্রদায়। ঐতিহাসিকদের ধারণা সিন্ধু উপত্যকাবাসীরা সেযুগে ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে বিদেশে যাতায়াত করতেন।

চ. সামাজিক অবস্থা : প্রথমত, হরপ্পা সভ্যতাবাসীদের সমাজিক জীবন সম্পর্কে আমাদের ধারণা তেমন কিছু নেই। নগরগুলোতে প্রাপ্ত নিদর্শনের ভিত্তিতে মোটামুটি একটা ধারণা করা গিয়েছে মাত্র। হরপ্পা-সভ্যতার কেন্দ্রগুলোতে দুই রকমের বাড়ীর ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গিয়েছে। এক রকমের বাড়ী ছিল যেগুলো সম্ভবত ব্যবসায়ীদের। এখানে প্রাপ্ত নিদর্শনগুলি থেকে বোঝা যায় যে, বাড়ীর মালিকরা বিত্তবান ছিল। অপরদিকে সারিবদ্ধ বাড়ীর বাসিন্দারা সম্ভবত ছিল বিত্তহীন শ্রমিক। তাদের বাড়ীগুলো ছিল অপেক্ষাকৃত ছোট এবং অতি সাধারণ। তাছাড়া বড় শস্যাগার থাকায় অনুমান করা হয় যে এখানে শাসক শ্রেণীর সম্পদ জড়ো করা হত।

ছ। ধর্মীয় জীবন :   প্রথমত, হরপ্পা সভ্যতার যুগে মানুষের ধর্মচচার অকাট্য প্রমাণ পাওয়া যায়নি। উপসনা গৃহ বা কোনও মন্দিরের ধ্বংসাবশেষও আবিষ্কৃত হয়নি। তবে কিছু কিছু মাটির মূর্তি এবং সীলমোহরে খোদাই করা মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে যা থেকে মোটামুটিভাবে হরপ্পা সভ্যতার যুগের ধর্ম-জীবন কিরূপ ছিল তা জানা যায়। পুরুষ এবং নারীর মূর্তি পাওয়া গিয়েছে বলে অনেকের ধারণা হরপ্পা সভ্যতার মানুষ দেব-দেবীর পূজায় অভ্যস্ত ছিল। সীলমোহরে তিন শৃঙ্গবিশিষ্ট যে যোগীপুরুষের মূর্তি পাওয়া গিয়েছে তা থেকে অনুমিত হয় যে তিনি সম্ভবত পরবর্তীকালে পশুপতি শিব হিসাবে ভারতবাসীর পূজা পেয়েছিলেন।

জ. উন্নত মানের সভ্যতা : এইভাবে হরপ্পা সভ্যতার বৈশিষ্ট্যসমূহ আমাদের এক উন্নত সভ্যতার কথা-ই স্মরণ করিয়ে দেয়। পরবর্তীকালে ভারতবর্ষে আর্যরা যে বৈদিক সভ্যতা গড়ে তুলেছিল তার চেয়ে হরপ্পা সভ্যতার মানুষ কোনমতেই কম উন্নত ছিল না। বরঞ্চ একথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে, কোন কোনও বিষয়ে হরপ্পা সভ্যতাবাসীরা আর্যদের অপেক্ষা অধিকতর উন্নতির পরিচয় দিয়েছিল।

ঝ. পতনের কারণ : হরপ্পা সভ্যতা সংক্রান্ত আলোচনা কোনমতেই শেষ হবে না যদি তার পতন সম্পর্কে দু-চার কথা বলা না হয়। হরপ্পা সভ্যতার মতো উন্নত সভ্যতার পতন কিভাবে ঘটেছিল তা ঐতিহাসিকমাত্রেই আলোচনার বিষয়। তবে এব্যাপারেও সঠিকভাবে কোনও কিছু বলা সম্ভব নয়। কোন কোনও ঐতিহাসিক হরপ্পা সভ্যতার পতনের জন্য প্রাকৃতিক কারণকে দায়ী করেছেন। আবার অন্যরা বহিরাগত জাতির আক্রমণের কথা জোরদারভাবে তুলে ধরেছেন। যাঁরা প্রাকৃতিক কারণকে গুরুত্ব দিয়েছেন তাদের ধারণা ভূপ্রকৃতির পরিবর্তন অথবা বন্যার ফলে হরপ্পা সভ্যতার পতন ঘটেছিল। বর্তমানে হরপ্পা সভ্যতার সবটাই প্রায় মরুভূমিতে পরিণত হয়েছে বলে প্রাকৃতিক কারণে পতনের ধারণাটা গুরুত্ব পেয়েছে। আবার বহিরাগত শত্রুর আক্রমণকে যাঁরা পতনের কারণ বলে চিহ্নিত করেছেন তাঁরা-ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোর উপর নির্ভর করেন। এমতাবস্থায় হরপ্পা সভ্যতার পতন ঠিক কি কারণে ঘটেছিল তা সঠিকভাবে নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি।


Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.