Economy and society in the Vijayanagar empire (WBCS history optional model question-answer)

 

A mantapa at Vitthala temple complex in Hampi



Q. Economy and society in the Vijayanagar empire with reference to the accounts of foreign travellers. (20/30)

পঞ্চদশ ও ষােড়শ শতকে একাধিক বিদেশী পর্যটক ও দূত বিজয়নগর রাজ্যে এসেছিলেন। এঁদের মধ্যে ইতালীয় পর্যটক নিকোলাে কন্টি, পারসিক দূত ও পর্যটক আব্দুর রজ্জাক, পর্তুগিজ বণিক ও পর্যটক ডােমিনগাে পায়েজ, ফার্নাও নুনিজ ও এডােয়ার্ডো বারবােসা এবং রাশিয়ান পর্যটক নিকিতন -এর নাম করা যেতে পারে। প্রধানত এঁদের বিবরণীকে ভিত্তি করেই বিজয়নগর রাজ্যের সমকালীন অর্থনীতি ও সমাজের চিত্র এই উত্তরে আলােচিত হয়েছে।

বিদেশী পর্যটকদের বর্ণনায় বিজয়নগর ছিল সমকালীন বিশ্বের অন্যতম সম্পদশালী রাজ্য। আব্দুর রজ্জাক লিখেছেন, রাজার কোষাগারে একাধিক প্রকোষ্ঠ আছে, যার প্রতিটি তরল সােনায় পরিপূর্ণ। রাজ্যের সমস্ত মানুষ উচ্চ-নীচ, এমনকি বাজারের কারিগররাও, দেহের নানা অঙ্গে অলঙ্কারাদি পরিধান করত। এডােয়ার্ডো বারবােসা লিখেছেন, নগরটি ছিল সুবিস্তৃত, জনবহুল এবং বাণিজ্যে অগ্রণী। পেগুর সাথে হীরা, রুবি, চীন ও আলেকজান্দ্রিয়ার সাথে সিল্ক এবং মালাবারের সাথে চন্দনকাঠ,কপূর ও নানা ধরনের মসলার বাণিজ্য চলত।

বিজয়নগর রাজ্যের আর্থিক সচ্ছলতা প্রসঙ্গে প্রায় সকল বিদেশী পর্যটকই একমত এবং এই সমৃদ্ধির প্রধান উৎস ছিল কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যের অগ্রগতি। কৃষিক্ষেত্রে বিজয়নগর ছিল খুবই উন্নত। ডােমিনগাে পায়েজ লিখেছেন, এদেশে প্রচুর ধান ও অন্যান্য শস্য উৎপন্ন হয়; কার্পাসের প্রচুর চাষ হয়। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির দিকে রাজাদের সজাগ দৃষ্টি ছিল। বেশিসংখ্যক জমিকে সেচের আওতায় আনার জন্য এবং অনাবাদী জমিকে চাষযােগ্য করে তােলার জন্য সরকারের তরফে নানা ব্যবস্থা গৃহীত হয়। সরকারি আয়ের প্রধান উৎস ছিল ভূমি-রাজস্ব। সাধারনভাবে উৎপন্ন ফসলের এক-ষষ্ঠাংশ ভুমি-রাজস্ব হিসেবে আদায় করা হত।


কৃষির পরেই ছিল বাণিজ্যের স্থান। অভ্যন্তরীণ ও বহির্বাণিজ্য উভয় ক্ষেত্রেই বিজয়নগর ছিল অগ্রণী একটি রাজ্য । আব্দুর রজ্জাক এখানে তিনশাে বন্দরের উল্লেখ করেছেন। মালাবার উপকূলে এযুগের ব্যস্ততম বন্দর ছিল কালিকট। পূর্ব-ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জ, ব্রহ্মদেশ, চীন, আরব, আবিসিনিয়া, পর্তুগাল প্রভৃতি। দেশের সাথে বিজয়নগরের বহির্বাণিজ্য চলত। প্রধান রপ্তানি-দ্রব্যাদির মধ্যে ছিল নানাধরনের বস্ত্র, সুগন্ধি মসলা, চাল, চিনি, সােরা, লােহা ইত্যাদি। বিদেশ থেকে আমদানি হত প্রধানত ঘােড়া, হাতি, তামা, কয়লা, পারদ, প্রবাল, ভেলভেট ইত্যাদি। স্থলপথ ও জলপথে অন্তর্দেশীয় বাণিজ্য চলত। উপকূলের বাণিজ্যে ছােট ছােট জলযান ব্যবহৃত হত। তবে বিজয়নগরে বড় জাহাজও তৈরি হত।

শিল্প-উৎপাদনের ক্ষেত্রে বস্ত্র-শিল্প, খনি-শিল্প ও ধাতু-শিল্প ছিল প্রধান। এছাড়া সুগন্ধ দ্রব্য উৎপাদনেও বিজয়নগরের খ্যাতি ছিল। এ যুগে শিল্প ও বাণিজ্যে গিল্ড’ বা বণিকসংঘের বিশেষ গুরুত্ব ছিল। আব্দুর রজ্জাক লিখেছেন, এক এক ধরনের শিল্প বা ব্যবসার জন্য এক-একটি স্বতন্ত্র গিল্ড বা সংঘ গড়ে উঠত।


বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে বিজয়নগরে মুদ্রার প্রচলন ছিল। সােনা ও তামার মুদ্রার প্রচলন ছিল বেশি। সামান্য পরিমাণ রৌপ্যমুদ্রাও প্রচলিত ছিল। সাধারনভাবে উচ্চ ও মধ্য শ্রেণীভুক্ত লােকেদের আর্থিক । সচ্ছলতা ছিল এবং এঁরা বিলাসব্যসনে জীবন অতিবাহিত করতে অভ্যস্ত ছিলেন। দেশের সাধারন মানুষ গরিব । হলেও নিত্যপ্রয়ােজনীয় জিনিস সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে বা জীবনধারণের ন্যূনতম সংস্থানের অভাব কারাে ক্ষেত্রে ছিল না।

বিজয়নগরের সমাজজীবনের বিস্তারিত চিত্র ফুটে উঠেছে বিদেশী পর্যটকদের বিবরণ থেকে। জাতিভেদ-প্রথা এবং আনুষঙ্গিক সামাজিক সম্পর্কের ধারা বিজয়নগরে বর্তমান ছিল। জাতিভেদ-প্রথার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সমাজব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখাই রাজার অন্যতম কর্তব্য বলে বিবেচিত হত। সমাজে ব্রাহ্মণদের সর্বাধিক সম্মান ছিল। বিজয়নগরের রাজারা ব্রাহ্মণদের বিশেষ মর্যাদা দিতেন। ফলে সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনে ব্রাহ্মণদের বিশেষ কর্তৃত্ব তাে ছিলই; ক্রমে রাজনীতিতেও তাঁদের প্রভাব বৃদ্ধি পেয়েছিল। পর্যটক ফানাও নুনিজ ব্রাহ্মণদের সৎ, দক্ষ, পরিশ্রমী, তীক্ষ্ণ মেধাসম্পন্ন এবং হিসাবশাস্ত্রে পারদর্শী বলে অভিহিত করেছেন। এডােয়ার্ডো বারবােসালিখেছেন, জাতিভেদ-প্রথা থাকলেও বিভিন্ন জাতির মধ্যে মেলামেশার কঠোরতা ছিল না।

বিজয়নগরের সমাজে নারীর বিশেষ মর্যাদা ছিল। রাজনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতির নানা ক্ষেত্রে নারীরা সক্রিয় অংশগ্রহণ করতেন। মুষ্টিযুদ্ধ, অস্ত্রবিদ্যা, মল্লযুদ্ধ প্রভৃতি কাজেও নারীরা রপ্ত ছিলেন। সংগীত, নৃত্য, সাহিত্য ইত্যাদি ক্ষেত্রে নারীদের দক্ষতা ছিল প্রশংসনীয়। গঙ্গাদেবী, তিরুমালাম্মা ছিলেন সে যুগের। প্রখ্যাত কবি। ফানাও নুনিজ লিখেছেন, বিজয়নগরের রাজা নারী-মল্লযােদ্ধা, নারী দ্বাররক্ষী, নারী-জ্যোতিষী ও নারী-হিসাবরক্ষক নিয়ােগ করতেন। বিদেশীদের বিবরণে বিজয়নগরে নারীদের দুটি ভাগে ভাগ করা যায় – গৃহস্থঘরের নারী ও ভ্রষ্টা নারী। গৃহস্থঘরের নারীরা কদাচিৎ ঘরের বাইরে বেরােতেন। এই কারনে পায়েজ এদের ‘অসামাজিক’ বলে অভিহিত করেছেন। ভ্রষ্টা নারীদের আবার দু'ভাগে ভাগ করা যায়; যথা- (১) যারা রাজধানীতে হালকা অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে স্বাধীনভাবে জীবিকা সংগ্রহ করতেন এবং (২) দেবদাসী।

সমাজে বাল্যবিবাহ, পুরুষদের বহুবিবাহ এবং সতীদাহ-প্রথা প্রচলিত ছিল। সচ্ছলশ্রেণীর লােকের বিবাহে পণপ্রথার ব্যাপকতা ছিল। বিদেশী পর্যটকেরা রাজাদের অসংখ্য পত্নী দেখে বিস্মিত হয়েছেন। নিজ লিখেছেন, রাজা অচ্যুত রায়ের পত্নীর সংখ্যা ছিল পাঁচশত। পায়েজের বিবরণ থেকে জানা যায়, রাজা কৃষ্ণদেব রায়ের আইনসম্মত বারােজন রানী ছিলেন।

পরিশেষে বলাযায়, বিদেশী পর্যটকদের বিবরণ থেকে বিজয়নগরের অর্থনীতি ও সমাজের সামগ্রিক চিত্র হয়তাে পরিস্ফুট হয় না, কারন তাঁদের অধিকাংশের অভিজ্ঞতা ছিল নগরকেন্দ্রিক। তথাপি সমকালীন বিজয়নগরের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে এই সকল বিদেশী পর্যটকদের বিবরণীর গুরুত্ব অপরিসীম।



2. Q. Write a short note on the Sabha and the Samiti. (10)

ঋকবেদে সভা ও সমিতি নামে দুটি প্রতিষ্ঠানের উল্লেখ আছে। অধ্যাপক লুডউইগের মতে, সভা ছিল উপজাতির প্রধানদের নির্বাচিত পরিষদ এবং সমিতি ছিল উপজাতির সর্বসাধারনের পরিষদ।

সমিতির অধিবেশনে রাজা, অভিজাত বা প্রধান ব্যক্তিরা ও জনসাধারণ একত্রে মিলিত হতেন। সমিতি রাজার কর্তব্যের নির্দেশ দিতে পারত। প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নিঃসন্দেহে সমিতির ক্ষমতা অনেক বেশি ছিল। এই রাষ্ট্রে সমিতিই ছিল শাসন ব্যবস্থার মূল কেন্দ্রে। অপরপক্ষে রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলিতেও সমিতির ক্ষমতা ঋকবেদের যুগে কম ছিল না। রাজা সমিতির অধিবেশনে পৌরােহিত্য করতেন। তিনি সমিতিতে সদস্যদের নানাভাবে প্রভাবিত করতে চাইতেন, কিন্তু সমিতিতে একবার কোনও সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে তা অমান্য করার অধিকার তাঁর ছিল না। ঋকবেদের সর্বশেষ স্তোত্রে সমিতির সদস্যদের বলা হয়েছে তাঁরা যেন একসঙ্গে চলেন (সংগচ্ছদ্ধন্), এক সুরে কথা বলেন (সংবদন্), তাঁদের মন, চিত্ত ও মন্ত্র যেন একসূত্রে গাঁথা থাকে, একই সঙ্কল্পে যেন তাঁরা উদবুদ্ধ থাকেন। সে যুগে সমিতি যথেষ্ট সক্রিয় ছিল বলে গােষ্ঠীপতি বা রাজা স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠতে পারেননি। পরবর্তী বৈদিক যুগে রাজার ক্ষমতা ও রাষ্ট্রের আয়তন বৃদ্ধির ফলে সমিতির ক্ষমতা অনেক পরিমাণে কমে যায়।

সভার সদস্যসংখ্যা সমিতির তুলনায় অনেক কম ছিল বলে মনে করা হয়। সভা ছিল। বয়ােজ্যেষ্ঠ ও জ্ঞানবৃদ্ধদের প্রতিষ্ঠান। এখানে মহিলাদের প্রবেশাধিকার ছিল না। ঋকবেদ থেকে জানা যায় যে সভায় পাশা খেলা হত। এর থেকে মনে হয় শুধু রাজনীতিই সভার আলােচ্য বিষয় ছিল না, সামাজিক অনুষ্ঠান ও খেলাধুলার আয়ােজনও সেখানে হত। সমিতির মতাে অত সক্রিয় না হলেও রাজার কার্যকলাপের উপর সভা সতর্ক দৃষ্টি রাখত। পরবর্তী বৈদিক যুগে তুলনামুলকভাবে সভার ক্ষমতা বাড়ে। রাজা সভার সম্মতি নিয়ে শাসনকার্য পরিচালনা করাকে উপযুক্ত মনে করতেন। অন্যথা সভা তাঁকে অনেকটা বিব্রত করতে পারত।


3. Q. Write an account of the character of the Revolt of 1857 with special emphasis on recent researches. (40)

1857 খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহের চরিত্র নির্ধারণের প্রধান অন্তরায় সমকালীন ঐতিহাসিক তথ্যের অভাব। বিদ্রোহী নেতা এবং বিদ্রোহের সঙ্গে যুক্ত অপরাপর ব্যক্তিগণ এমন কোনাে রচনা, দলিল বা চিঠিপত্র রেখে যাননি যার ভিত্তিতে বস্তুনিষ্ঠ ও নির্মোহ ইতিহাস রচনা সম্ভব। মহাবিদ্রোহের অব্যবহিত পরেও কোনাে ভারতীয়ের পক্ষে নির্ভীক ও পক্ষপাতহীন ইতিহাস রচনা সম্ভব ছিল না। ফলে মহাবিদ্রোহের ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে আমাদের কোম্পানি ও ব্রিটিশ সরকারের দলিলপত্র এবং ইংরেজ রাজপুরুষ, সেনাধ্যক্ষ ও ঐতিহাসিকদের রচনার ওপর নির্ভর করতে হয়। তবে সাম্প্রতিককালে গবেষণার ফলে মহাবিদ্রোহ সম্পর্কে তৃণমূল স্তরে অনেক নতুন তথ্য সংগৃহীত হয়েছে। এর ওপর ভিত্তি করে গবেষকগণ নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে মহাবিদ্রোহকে বিচার করতে শুরু করেছেন। বিশেষ করে মহাবিদ্রোহের দেড়শাে বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে এই উদ্যোগ নতুন মাত্রা পেয়েছে।

মহাবিদ্রোহের চরিত্র সম্পর্কে সমসাময়িক ব্রিটিশ লেখকগণ দু-ভাগে বিভক্ত ছিলেন। জেবিনটন তাঁর Topics for Indian Statesman গ্রন্থে লিখেছিলেন, এটি একটি সামান্য সিপাহী বিদ্রোহ ছিল না; এই অভ্যুত্থান একটি গণবিদ্রোহের রূপ নিয়েছিল। ডাফ, ম্যালেসন, জন কে, চার্লস বল প্রমুখ লেখক এই মত সমর্থন করে বলেছেন 1857 খ্রিস্টাব্দের অভ্যুত্থান ভারত থেকে ব্রিটিশ বিতাড়নের একটি সুসংবদ্ধ প্রয়াস। কিন্তু চালর্স রেকস তাঁর Notes on the Revolt in North Western Province of India-তে বলেছিলেন, এটা ছিল একটি সিপাহী বিদ্রোহ। তাৎপর্যপূর্ণ। বিষয় হল প্রায় সব সমসাময়িক ভারতীয় লেখকই চার্লস রেক-এর মতকে সমর্থন করেছেন। এঁদের মধ্যে রয়েছেন। দুর্গাদাস বন্দোপাধ্যায়, কিশােরী চাঁদ মিত্র, হরিশচন্দ্র মুখার্জি, রাজনারায়ান বসু প্রমুখ। তৎকালীন শিক্ষিত বাঙালির ব্রিটিশ অনুরাগ এর দ্বারা প্রতিফলিত হয়েছে। তা ছাড়া স্যার সৈয়দ আহমেদ খানও মহাবিদ্রোহকে নিছক সিপাহী বিদ্রোহ বলেই মনে করতেন।

ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সমর্থক ইংরেজ ঐতিহাসিকদের মধ্যে স্যার জন লরেন্স এবং সিলি এই বিদ্রোহকে “দেশদ্রোহী ও স্বার্থপর” সিপাহীদের বিদ্রোহ বলেছেন। তাঁদের মতে এই বিদ্রোহের পেছনে কোন সংগঠিত নেতৃত্ব বা জনসমর্থন ছিল না। আর.রিজ এই বিদ্রোহকে ধর্মান্ধ হিন্দু ও মুসলমানদের খ্রিস্টধর্ম-বিরােধী জেহাদ হিসেবে দেখেছেন।

মহাবিদ্রোহের চরিত্র বিশ্লেষণে জাতীয়তাবাদী ঐতিহাসিকগণ একমত পােষণ করেন না। তাঁদের একাংশের মতে এটি জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম। রজনীকান্ত গুপ্ত তাঁর সিপাহী যুদ্ধের ইতিহাস গ্রন্থে স্বীকার করেছেন যে সিপাহীরা । জাতীয়তাবাদী আদর্শে উদ্দীপ্ত হয়েই ইংরেজ শাসনের অবসান চেয়েছিল। সিপাহী বিদ্রোহের শতবার্ষিকী উপলক্ষ্যে রচিত গ্রন্থে বিপ্লবী বিনায়ক দামােদর সাভারকর মহাবিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ’ আখ্যা দিয়েছেন। ঐতিহাসিক শশিভূষণ চৌধুরী তাঁর Civil Rebellion in the Indian Mutinies গ্রন্থে 1857 সালের অভ্যুত্থানকে একটি সাম্রাজ্যবাদ-বিরােধী জাতীয় যুদ্ধ বলেই ক্ষান্ত হন নি, তিনি এটিকে গণবিদ্রোহ বলেও আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর মতে ভারতের দরিদ্র শ্রেণীর মানুষ তীব্র ব্রিটিশ-বিরােধী সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিলেন এবং এই সংগ্রামের নেতারা “জাতীয়তাবাদের অচেতন যন্ত্র”হিসাবে কাজ করেছিলেন।

অপরদিকে ঐতিহাসিক ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার 1857 খ্রিস্টাব্দের অভ্যুত্থানকে কোনাে মতেই জাতীয় বা ‘স্বাধীনতার যুদ্ধ’ আখ্যা দিতে রাজি নন। এটি একটি সিপাহী বিদ্রোহ ছিল মাত্র। তাঁর মতে, অভ্যুত্থান প্রধানত বর্তমান। উত্তরপ্রদেশ ও তার নিকটবর্তী অঞ্চলেই সীমাবদ্ধ ছিল। ভারতের অধিকাংশ অঞ্চল এই অভ্যুত্থানে সাড়া দেয়নি। অতএব একে জাতীয় চরিত্রে ভূষিত করা যুক্তিযুক্ত নয়। তাছাড়া, যেকোনাে ব্রিটিশ-বিরােধী যুদ্ধকেই স্বাধীনতার যুদ্ধ বলা যায় না। কি উদ্দেশ্যে এই যুদ্ধ পরিচালিত হচ্ছে ও কোন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ব্রিটিশ শক্তিকে দেখা হচ্ছে সেটাই বিচার্য বিষয়। তাঁর মতে বিদ্রোহের নেতারা বিদেশি শাসনের অবসানকল্পে কোনাে দেশপ্রেমিক সংকল্প নিয়ে এই অভ্যুত্থান ঘটায়নি। অনেক দেশীয় রাজন্য রাজ্য হস্তচ্যুত হওয়ায় ক্ষুব্ধ ছিলেন; অনেক জমিদার-তালুকদার জমিদারি হস্তচ্যুত হওয়ায় ক্ষুব্ধ ছিলেন; অনেক রাজন্য তাঁদের দত্তকপুত্রের উত্তরাধিকার নাকচ হওয়ায় ক্ষুব্ধ ছিলেন। এঁরা সকলেই বিদ্রোহে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। অতএব সকলেই সংকীর্ণ স্বার্থবুদ্ধির দ্বারা পরিচালিত হয়েছিলেন। ডঃ মজুমদারের মতে মহাবিদ্রোহকে স্বাধীনতার যুদ্ধ আখ্যা দেওয়ার মধ্যে আবেগপ্রবনতাই বেশি, বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাসবােধ কম। কারণ ভারতীয়দের জাতীয়তাবাদী চেতনা তখনাে দ্রুণ অবস্থায় ছিল। ডঃ সুরেন্দ্রনাথ সেন তাঁর Eighteen Fifty Seven গ্রন্থে বলেছেন, সিপাহীদের অভ্যুত্থানের সুযােগে একদল হতাশ সামন্তপ্রভু নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তুলেছিল। বিদ্রোহের পেছনে কোন জাতীয় নেতৃত্বের বা জাতীয় স্তরে কোন পরিকল্পনার আস্তিত্ব ছিল না এবং অভ্যুত্থানগুলি হয়েছিল বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষিপ্তভাবে। তাই ডঃ সেনও এই বিদ্রোহকে জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম হিসাবে মেনে নিতে নারাজ।

মার্কসবাদী ইতিহাসচর্চাতেও মহাবিদ্রোহের চরিত্র নির্ধারণে ঐকমত্য লক্ষ করা যায় না। স্বয়ং কার্ল মার্কস New York Daily Tribune পত্রিকায় এই অভ্যুত্থান সম্পর্কিত প্রবন্ধে এটিকে “ভারতের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম” হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। কিন্তু ভারতে মার্কসবাদী ঐতিহাসিকদের অন্যতম পুরােধা রজনীপাম দত্ত এই বিদ্রোহকে ক্ষয়িষ্ণু ও পতনােন্মুখ সামন্তপ্রভুদের নিজেদের স্বার্থরক্ষার শেষ প্রতিক্রিয়াশীল প্রয়াস হিসেবে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু পরবর্তীকালে মার্কসবাদী ঐতিহাসিকেরা বিশেষতঃ প্রমােদ সেনগুপ্ত, সুপ্রকাশ রায় প্রমুখ এই মহাবিদ্রোহকে ভারতীয় জনসাধারণের সাম্রাজ্যবাদ-বিরােধী গৌরবময় সংগ্রামের কাহিনী হিসেবে দেখেছেন। প্রমােদ সেনগুপ্ত তাঁর ভারতীয় মহাবিদ্রোহ গ্রন্থে বিভিন্ন অঞ্চলের অভ্যুত্থানের গতিপ্রকৃতি তথ্য সহকারে পর্যালােচনা করে দেখিয়েছেন যে লক্ষ্ণৌ, । অযােধ্যা, বিহার সর্বত্রই এই বিদ্রোহ গণঅভ্যুত্থানের রূপ নিয়েছিল। কোনাে কোনাে অঞ্চলে বিদ্রোহীরা সুপরিকল্পিতভাবে। গেরিলা যুদ্ধের কৌশল নেয়। তিনি দেখিয়েছেন, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সমর্থক জমিদার, মহাজন, বানিয়ারাও বিদ্রোহীদের আক্রমণের শিকার হয়েছিল। সুপ্রকাশ রায়ও বলেছেন, সিপাহীরা যখন সাম্রাজ্যবাদ-বিরােধী প্রতিরােধ সংগ্রাম গড়ে তুলেছিলেন, তখন তাঁদের আত্মীয়স্বজন যাঁরা গ্রামাঞ্চলে কৃষি বা অন্যান্য পেশায় নিযুক্ত ছিলেন বা পেশাচ্যুত হয়েছিলেন তাঁরাও ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের মদতপুষ্ট স্থানীয় জমিদার ও মহাজনদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিলেন।

কেমব্রিজ ঐতিহাসিক এরিক স্টোকস অবশ্য এই বিদ্রোহে জনগণের অংশগ্রহণের বিষয়টিকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করেছেন। তাঁর মতে একদল গ্রামীণ ভূস্বামী ও সামন্তপ্রভু এই বিদ্রোহে অংশ নিয়েছিলেন এবং তাঁদের একদল অনুরাগী তাঁদের অনুসরণ করেছিল মাত্র। সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ এই বিদ্রোহে পরিলক্ষিত হয় নি। অপর কেম্ব্রিজ ঐতিহাসিক সি.এ.বেইলি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এই বিদ্রোহের প্রকৃতি আলােচনা করে বলেছেন, বিদ্রোহের সূচনাপর্ব থেকেই অসামরিক মানুষের বিদ্রোহ এবং সিপাহীদের অভ্যুত্থান একে অপরকে শক্তিশালী করেছিল। যদিও বিদ্রোহীদের আশাআকাক্ষা চরিতার্থ করার জন্য কোন সুসংবদ্ধ মতাদর্শ বা কর্মসূচী ছিল না। এছাড়া বিদ্রোহের ভিত্তি কোনমতেই জাতীয়তাবাদ ছিল না কারণ প্রান্তিক অথবা অবক্ষয়প্রাপ্ত এলাকাগুলি থেকেই দীর্ঘ প্রতিরােধ উঠে এসেছিল।

টমাস মেটকাফ মহাবিদ্রোহের চরিত্র সম্পর্কে বলেছিলেন, একটি মতৈক্য আছে যে এই বিদ্রোহ কখনাে কখনাে সিপাহী বিদ্রোহকে ছাপিয়ে গেছে, কিন্তু কখনােই জাতীয় বিদ্রোহের পর্যায়ে পৌঁছতে পারেনি। শেখর বন্দ্যোপাধ্যায় দেখিয়েছেন এই মতৈক্যের বিষয়ে কোন কোন ঐতিহাসিক সাম্প্রতিককালে প্রশ্ন তুলেছেন। 1857 খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহীদের মধ্যে আধুনিক অর্থে ভারতীয় জাতীয় ধারণা ছিল না। কৃষকের কাজকর্ম সীমাবদ্ধ ছিল সুনির্দিষ্ট ভৌগােলিক সীমানার মধ্যে। কিন্তু পূর্ববর্তী কৃষকবিদ্রোহগুলির থেকে মহাবিদ্রোহ ছিল কিছুটা স্বতন্ত্র। বিভিন্ন অঞ্চলের বিদ্রোহীদের মধ্যে যােগাযােগ ও সমন্বয় ছিল। নানারকম গুজব তাদের এক অদৃশ্য বন্ধনে বেঁধে রাখে। বিদ্রোহীদের অপর বন্ধন হল ব্রিটিশ রাষ্ট্রের প্রতি বিতৃষ্ণা। কারণ এই রাষ্ট্রই তাদের জীবনে বিপর্যয় ডেকে এনেছে। অতএব ব্রিটিশদের সমর্থনকারী যেকোনাে কর্তৃত্বকেই তারা আঘাত হানতে তৈরি ছিল। তাপ্তি রায় মনে করেন বিদ্রোহীরা বিশ্বাস করত বিদেশি শক্তির অনুপ্রবেশ ও শাসনের ফলে তাদের ধর্ম ও বর্ণ আক্রান্ত।

রুদ্রাংশু মুখার্জি তাঁর সাম্প্রতিক গবেষণায় মহাবিদ্রোহের চরিত্রের দুটি দিকের উপর বিশেষ আলােকপাত করেছেন। প্রথমতঃ এরিক স্টোকস প্রমুখ ঐতিহাসিকরা যেখানে এই বিদ্রোহের পরিচালনার পিছনে সামন্তপ্রভুদের মতাে উচ্চকোটির মানুষের ভূমিকাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন; সেখানে অযােধ্যার দৃষ্টান্তে রুদ্রাংশু মুখার্জি দেখিয়েছেন যে অযােধ্যার তালুকদারদের কেউ কেউ ব্রিটিশের প্রতি অনুগত থাকে, আবার অনেকে বিদ্রোহীদের পক্ষে যােগ দেয়। অনেক ক্ষেত্রে কৃষক ও হস্তশিল্পীদের চাপে তালুকদার বিদ্রোহে যােগ দিয়েছিল। কোন কোন ক্ষেত্রে তালুকদাররা ব্রিটিশের সঙ্গে শান্তিস্থাপন করে নিলেও জনসাধারণ বিদ্রোহ চালিয়ে গেছে। বস্তুত রুদ্রাংশু মুখার্জির গবেষণায় pressure from below বা বিদ্রোহে নিচুতলার মানুষের চাপটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। দ্বিতীয়তঃ রুদ্রাংশু মুখার্জির মতে সিপাহীদের ‘বিদ্রোহী চেতনার সাথে কৃষক মানসিকতার অনেক মিল আছে। বিদ্রোহের প্রধান উদ্যোগটি এসেছিল সিপাহীদের দিক থেকে যারা ছিল আদতে ‘উর্দিপরা কৃষক’ অভ্যুত্থানের সময় তারা উর্দি ছেড়ে কৃষকদের সঙ্গেই মিশে যায়। ফলে উত্তর ও মধ্য ভারতের বিভিন্ন স্থানে সেনাছাউনিতে অভ্যুত্থানের প্রভাব পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলিতে পৌঁছে যেত। সিপাহী-কৃষক চেতনার এই সমন্বয়কে রুদ্রাংশু মুখার্জি ‘জাতীয়তাবাদ-পূর্ব দেশপ্রেম’ আখ্যা দিয়েছেন।

উপরের আলােচনার ভিত্তিতে বলা যায় 1857 খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহ সর্বভারতীয় জাতীয় চরিত্র অর্জন করতে পারলেও বিচ্ছিন্নভাবে উত্তর ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে তা গণ-অভ্যুত্থানের রূপ নেয়। আধুনিক অর্থে মহাবিদ্রোহ। জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম ছিল না। কারণ তখন জাতীয়তাবাদী চেতনার স্ফুরণ ঘটেনি। তাই বলা যেতে পারে মহাবিদ্রোহ সিপাহী বিদ্রোহকে ছাড়িয়ে অনেক পথ অগ্রসর হয়েছে কিন্তু কখনাে তা জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের পর্যায়ে পৌঁছতে পারেনি।


4.Q. What do you understand by the ‘Cuban Missile Crisis'? (20)

1950-এর দশকে ঠাণ্ডা লড়াই (Cold War)-এর মূল বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায় অস্ত্রশস্ত্রের প্রতিদ্বন্দ্বিতা। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একটি সংকটের সূত্রপাত করে যা কার্যত পৃথিবীকে পারমাণবিক একটি সংঘাতের প্রান্তে উপনীত করে। এই সংকট কিউবার মিসাইল সংকট নামে পরিচিত।

পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জের সর্ববৃহৎ দ্বীপ হল কিউবা। বিংশ শতকের শুরু থেকেই আর্থিকভাবে কিউবা একটি মার্কিন উপনিবেশে পরিণত হয়েছিল। অর্থাৎ কিউবার অর্থনীতি মার্কিনী মূলধনিদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত। কিউবা ছিল বিশ্বের সর্বাধিক চিনি উৎপাদনকারী দেশ। তামাক উৎপাদনেও কিউবা যথেষ্ট অগ্রণী ছিল। কিন্তু এইসব উৎপাদনের ওপর মার্কিন মূলধনিদের একচেটিয়া কর্তৃত্ব থাকায় এদেশের সাধারণ মানুষকে চরম দারিদ্র্য ও দুর্দশার মধ্যে কালাতিপাত করতে হত। মার্কিন পৃষ্ঠপােষকতায় 1952 খ্রিস্টাব্দে ফ্যালজেনিকো বাতিস্তা একটি অভ্যুত্থানের মাধ্যমে কিউবার রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন এবং 1954 খ্রিস্টাব্দে তিনি কিউবার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।

দারিদ্র্য, অসাম্য, দুর্নীতি ও স্বৈরতন্ত্রের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং মার্কিন-সমর্থনপুষ্ট বাতিস্তা সরকারের পেছনে জনসমর্থন ছিল না। এমতবস্থায় এক বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে 1959 খ্রিস্টাব্দের 1 জানুয়ারি ফিদেল কাস্ত্রো কিউবাতে একটি উদারনৈতিক সরকার গঠন করতে সমর্থ হন। কাস্ত্রো সােভিয়েত রাশিয়া, চীন এবং সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তােলেন, বড়াে বড়াে খামার, বিদেশি শিল্প। ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানগুলি জাতীয়করণ করেন এবং নানা ধরনের বৈপ্লবিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ করে জনগণের উন্নতি বিধানে সচেষ্ট হন। কাস্ত্রো-অনুসৃত এইসব প্রগতিশীল নীতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থের পরিপন্থী ছিল।

1961 খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে কিউবা রাজধানী হাভানার মার্কিন দূতাবাসে কর্মীর সংখ্যা 11-র মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার দাবি জানালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিউবার সঙ্গে সকল কুটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে এবং নবগঠিত এই সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে ধ্বংসের উদ্যোগ নেয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ফ্লোরিডা ও | গুয়াতেমালার শরণার্থী শিবিরে অবস্থানরত কিউবার কমিউনিস্ট-বিরােধী দেশত্যাগীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে কাস্ত্রো সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে মদত দিতে থাকে। 1961 খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে মার্কিন উদ্যোগে কাস্ত্রো সরকারের উচ্ছেদের উদ্দেশ্যে 1400 কাস্ত্রো-বিরােধী কিউবান নিকারাগুয়া থেকে এসে Bay of Pigs-এ অবতরণ করে। বিদ্রোহীদের সাহায্যের জন্য মার্কিন B-26 বােমারু বিমান প্রস্তুত ছিল। যদিও কাস্ত্রোর সেনাবাহিনী অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সেই মার্কিন মদতপুষ্ট প্রতিবিপ্লবী অভ্যুত্থানকে ব্যর্থ করে দেয়। এর পরেই ফিদেল কাস্ত্রো প্রকাশ্যে ঘােষণা করেন যে তিনি মার্কসবাদী এবং তাঁর দেশ কিউবা এখন থেকে একটি সমাজতন্ত্রী দেশ।

এরপরেই সােভিয়েত ইউনিয়ন কিউবার সামরিক প্রতিরক্ষার প্রয়ােজনে সেখানে মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র (missile launcher) বসানাের কর্মসূচী গ্রহণ করে। সােভিয়েত প্রধানমন্ত্রী নিকিতা ক্রুশ্চেভ । কিউবাতে 2000 মাইল দূরত্বের মিসাইল প্রতিস্থাপন করতে চেয়েছিলেন, যার অর্থ ছিল নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন, চিকাগাে ও বস্টনের মতাে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য ও পূর্ব ভূখণ্ডের সবকটি প্রধান প্রধান শহরই সােভিয়েত আক্রমনের আওতায় চলে আসা। 1962 সালের অক্টোবরে মার্কিন গুপ্তচর বিমান থেকে গৃহীত ঐরূপ বেশ কয়েকটি ক্ষেপণাস্ত্রঘাঁটির ছবি প্রকাশিত হলে সমগ্র আমেরিকা জুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সঞ্চার হয়। ঐ মাসের মধ্যেই সােভিয়েত ইউনিয়ন প্রস্তাবিত মােট 64টি ক্ষেপণাস্ত্রের মধ্যে 42টি কিউবায় পাঠিয়ে দিয়েছিল।

এখন প্রশ্ন হল ক্রুশ্চেভের এরূপ ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপের পেছনে কি শুধুই সাম্যবাদী রাষ্ট্র কিউবার নিরাপত্তা রক্ষার স্বার্থ ছিল ? এর উত্তরে বলা যায় যে এই ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচী গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে সােভিয়েত শীর্ষনেতৃত্ব আমেরিকার প্রায় অনুরূপ চ্যলেঞ্জের যােগ্য জবাব দিতে চেয়েছিল। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রায় একইভাবে ইতিপূর্বে তুরস্কে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিষ্ঠাপ্রকল্প সম্পূর্ণ করেছিল এবং সেইসব ক্ষেপণাস্ত্রগুলি সােভিয়েত রাশিয়ার নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষায় একটা বড়াে প্রশ্নচিহ্ন তুলে ধরেছিল।

যাইহােক, কিউবায় রুশ ক্ষেপণাস্ত্র প্রকল্পের কথা ফাঁস হয়ে গেলে মার্কিন প্রেসিডেন্ট কেনেডির ওপর সােভিয়েত রাশিয়ার বিরুদ্ধে পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য চাপ বাড়তে থাকলাে। 1962 খ্রিস্টাব্দের 22 অক্টোবর। এক বেতার ঘােষণা মারফত কেনেডি কিউবার চতুর্দিকে নৌ-অবরােধের ব্যবস্থা করেন এবং ঘােষণা করেন যে, কিউবাগামী সব দেশের জাহাজ- এমনকি সােভিয়েত রাশিয়ার জাহাজও অনুসন্ধানের পর, তবেই তা কিউবায় যেতে দেওয়া হবে। মার্কিন রাষ্ট্রপতি দৃঢ় ভাষায় বলেন যে, কিউবা থেকে কোনাে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এজন্য সােভিয়েত রাশিয়াকে দায়ী করবে, এবং সােভিয়েত রাশিয়ার ওপর পালটা আক্রমণ। হানার ব্যাপারে কোনাে দ্বিধা করা হবে না। কেবলমাত্র এই নয়- তিনি রুশ প্রধানমন্ত্রী ক্রুশ্চেভের কাছে কিউবা থেকে আক্রমণাত্মক অস্ত্রশস্ত্র অপসারণ এবং পৃথিবীকে আসন্ন যুদ্ধের সম্ভাবনা থেকে রক্ষা করার অনুরােধ জানান।

রাষ্ট্রপতি কেনেডির এই ঘােষণায় রুশ প্রতিক্রিয়া হয় মারাত্মক। সােভিয়েত সরকার তাঁর সেনাবাহিনীকে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেয়। সােভিয়েত সরকার স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয় যে, কিউবাগামী কোনাে জাহাজ বাধাপ্রাপ্ত হলে যেন সঙ্গে সঙ্গে গুলি চালানাে হয়।

ঘটনা পরম্পরায় পরস্থিতি রীতিমত জটিল হয়ে ওঠে এবং বিশ্ব এক আসন্ন পরমাণুযুদ্ধের আশঙ্কায় বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। এই প্রশ্নে রাষ্ট্রসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের জরুরী বৈঠক আহূত হয়। রাষ্ট্রসংঘের তৎকালীন মহাসচিব ইউ থান্ট যুযুধান উভয়পক্ষকেই সংযত ও স্থিতাবস্থা বজায় রাখার আবেদন জানান। এদিকে মার্কিন অবরােধ চালু হলেও শেষ অবধি সােভিয়েত জাহাজে তল্লাসি চালানাের প্রয়ােজন ঘটেনি কারণ রাশিয়া ক্ষেপণাস্ত্রবাহী জাহাজগুলিকে অবরােধ সীমার বাইরে ঘুরিয়ে নেয়। 26 অক্টোবর 1962 ক্রুশ্চেভ নতুন করে প্রস্তাব রাখেন যে, তুরস্ক থেকে আমেরিকা জুপিটার ক্ষেপণাস্ত্র সরিয়ে নিলে রাশিয়াও কিউবা থেকে তার ক্ষেপণাস্ত্রগুলি প্রত্যাহার করে নেবে। পরদিন 27 অক্টোবর সােভিয়েত কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয় কিউবা থেকে। ক্ষেপণাস্ত্রসম্ভার সরিয়ে নেওয়া হবে। এর পরেই কেনেডি প্রতিশ্রুতি দেন যে আমেরিকা আর নতুন করে কিউবা আক্রমণ করবে না এবং তুরস্ক থেকেও মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্রগুলি প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। এইভাবে দুই রাষ্ট্রপ্রধানের শুভবুদ্ধির প্রভাবে বিশ্ব একটি সর্বনাশা মহাযুদ্ধের হাত থেকে রক্ষা পায়।

কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র সংকটের মধ্য দিয়ে দুই মহাশক্তিধর রাষ্ট্র অতঃপর অনুভব করেছিল যে নিজেদের অস্তিত্বের কারণেই দুপক্ষের মধ্যে যুদ্ধ কোনাে অবস্থাতেই কাম্য নয়। এই সময় থেকে বিশ্বরাজনীতি

ক্রমশ সমঝােতানির্ভর বা আলাপ আলােচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধানকামী হয়ে ওঠে। এই পরিবর্তিত কূটনৈতিক পদক্ষেপ ঠাণ্ডা লড়াই-এর ইতিহাসে ‘দাঁতাত' detente) নামে পরিচিত হয়েছিল।


[Written by : D. Basu]

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.