ইতিহাস ও ভৌগোলিক পরিবেশ (PART-2)

 


 

প্রশ্ন-1 : প্রাচীন ভারতের ঐতিহাসিক উপাদান হিসাবে মুদ্রার গুরুত্ব সংক্ষেপে লেখ। 

উত্তর : সাম্প্রতিককালে ঐতিহাসিকরা একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস-রচনার উপাদান হিসাবে মুদ্রার গুরুত্ব সর্বাধিক। কারণ মুদ্রাতে বিশেষজ্ঞরা এমন সব তথ্য খুঁজে পান যা অপর আর কোনও কিছুতেই পাওয়া যায় না। মুদ্রায় ব্যবহৃত ধাতু থেকে কেবল সে দেশের ধাতু-শিল্পের ই যে পরিচয় পাওয়া যায় এমন নয়, অর্থনীতির ও পরিচয় পাওয়া সম্ভব। আবার মুদ্রার প্রাপ্তিস্থান রাজ্যের পরিধি নির্ণয়ে ও সাহায্য করে থাকে। যেমন : কোনও রাজার প্রচারিত মুদ্রা যেসব এলাকায় পাওয়া যাবে সেইসব জায়গা যে তাঁর রাজ্যভুক্ত ছিল তা ধরে নেওয়া যেতে পারে। অন্তত সেইসব এলাকার সঙ্গে যে আর্থিক যোগাযোগ ছিল তা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। মুদ্রায় খোদাই করা বা ছাপ দেওয়া রাজার ছবি দেখে বা রাজার নামাঙ্কন থেকে সেই রাজা কে ছিলেন তা সনাক্ত করা যায়। এমনকি, কুষাণরাজদের মুদ্রায় তারিখ দেওয়া থাকত বলে জানা সম্ভব হয়েছে যে তিনি কোন্ সময়কার মানুষ। এমন-ই আরও অনেক তথ্য মুদ্রা-বিশারদরা মুদ্রা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আবিষ্কার করে থাকেন। যার ফলে ইতিহাস রচনায় মুদ্রার গুরুত্ব অত্যধিক।

 প্রশ্ন-2 : ইতিহাসের উপাদান' বলতে কি বোঝায় ?

উত্তর : ইতিহাসের উপাদান’ বলতে বোঝায় সেইসব সূত্র যার ভিত্তিতে ঐতিহাসিকরা ‘ইতিহাস’ পুনর্গঠন করেন। দেশ এবং কাল (সময়) হিসাবে ঐতিহাসিক উপাদানের তারতম্য ঘটে থাকে। যখন মানুষ লিখতে জানতো না তখনকার ইতিহাস পুনর্গঠন করা হয় প্রাচীন নিদর্শন থেকে। আবার যেদেশে ইতিহাস-গ্রন্থ দেরীতে রচিত হয়েছে সে দেশের ইতিহাস রচনার জন্য নির্ভর করতে হয় বৈদেশিক বিবরণ, কাব্য-সাহিত্য অথবা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের ওপর। আধুনিক যুগের ইতিহাস রচনার উপাদান অবশ্য সহজলভ্য। কারণ এখন তো সবকিছুই লিখিতভাবে হতে শুরু করেছে।

প্রশ্ন-3 : ভারত-ইতিহাস পুনর্গঠনে প্রত্নতত্ত্বের গুরুত্ব কতখানি ? 

উত্তর : প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ যা-কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ঐতিহাসিক তথ্য নিরূপণ করা হয় তা-ই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবার নানা রকমের হতে পারে। যেমন : শিলালিপি, গুহালিপি, তাম্রলিপি, দেবালয়ের ধ্বংসাবশেষ প্রভৃতি। বাস্তবিকপক্ষে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস অনেকখানি-ই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের ভিত্তিতে রচিত হয়েছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে যে, হরপ্পা সভ্যতা সম্পর্কে এখনও পর্যন্ত যা কিছু জানা সম্ভব হয়েছে তা এই প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের ভিত্তিতেই। কারণ ঐ সভ্যতায় কোনও লিখিত ইতিহাস এখনও পর্যন্ত আমাদের হস্তগত হয়নি। কেবল হরপ্পা সভ্যতা-ই নয়, অশোকের আমলে উৎকীর্ণ শিলালিপি প্রভৃতি সে যুগের ইতিহাস রচনায় যথার্থ সাহায্য করে। আবার সমুদ্রগুপ্তের রাজ্যের কাহিনী জানা যায় হরিষেণ বিরচিত 'এলাহাবাদ প্রশস্তি' থেকে। এইভাবে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলি প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনার বিশেষ সহায়ক।

 প্রশ্ন -4 : বৈদেশিক বিবরণ প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় কতখানি সাহায্য করে ? 

উত্তর : হিমালয় পর্বত ভারতবর্ষকে প্রাকৃতিক দিক দিয়ে বিচ্ছিন্ন করে রাখলেও বিভিন্ন দেশের মানুষের সঙ্গে ভারতের সাংস্কৃতিক বা রাজনৈতিক যোগাযোগের অভাব হয়নি। অর্থাৎ প্রাকৃতিক বাধা অতিক্রম করে ভারতের মানুষ যেমন বিদেশে উপস্থিত হয়েছিল, তেমনি প্রতিবেশী দেশসমূহ তো বটেই এমনকি, সুদূর ইওরোপ বা আফ্রিকা থেকেও নানা উদ্যে নিয়ে বিদেশীরা ভারতবর্ষে উপনীত হয়েছিলেন। বিদেশীরা ভারতবর্ষে যেমন এসেছিলেন নিছক বেড়াবার উদ্দেশ্য নিয়ে, তেমনি এসেছিলেন ধর্ম সম্পর্কে জানবার লক্ষ্য নিয়ে। এইসব ভ্রমণকারীর লিখিত বিবরণ থেকে ভারতবর্ষ সম্পর্কে নানা তথ্য জানা যায়। অবশ্য কোন কোন বিদেশী পে-করেও এদেশ সম্পর্কে নানাকিছু লিখে গিয়েছেন যেমন মিনি। অনেকে তো বুঝতে না পেরে এমন সব তথ্য সরবরাহ করেছেন যা আমাদের দেশের ঐতিহ্যের সঙ্গে খাপ খায় না। এমতাবস্থায় বিদেশীদের লেখা ভারত-বিবরণ যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গে ব্যবহার করা প্রয়োজন। বিদেশীদের মধ্যে যাঁদের রচনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তাঁরা হলেন: মেগাস্থিনিস, ফা-হিয়েন, হিউয়েন-সাঙ প্রমুখ।

 প্রশ্ন-5 : ভারতীয় ইতিহাসে ভৌগোলিক প্রভাব আলোচনা কর।

উত্তর : ক. সূচনা : প্রত্যেক দেশের মানুষ তার মাতৃভূমির ভৌগোলিক পরিবেশ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে থাকে। দেশের মানুষকে নিয়েই ইতিহাসের কাজ-কারবার বলে প্রাকৃতিক পরিবেশ ইতহাসকেও যে প্রভাবিত করবে তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। প্রকৃতির সৃষ্টি হিমালয় বা বিন্ধ্যপর্বত যেমনভাবে ভারতের ইতিহাসকে প্রভাবিত করেছে, তেমনি নদনদী বা সমুদ্রের প্রভাব ও নিতান্ত কম নয়।

খ. প্রথমত, ভারতের উত্তরে অবস্থিত হিমালয় পর্বত এদেশের ইতিহাসকে যেভাবে প্রভাবিত করেছে তার তুলনা মেলা ভার। উদাহরণ হিসাবে বলা যেতে পারে যে, হিমালয় পর্বত এদেশকে বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে অনেকটা নিরাপদ রেখেছে। আবার বহির্জগত থেকে এদেশকে বিচ্ছিন্ন -ও করে রেখেছে । অবশ্য দুটোর কোনওটাই আক্ষরিক অর্থে সম্পূর্ণ ছিল না। ভারতবর্ষ বৈদেশিক আক্রমণ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত যেমন থাকেনি, আবার বহির্জগত থেকে একেবারে বিচ্ছিন্নও থাকেনি। আর্যদের থেকে শুরু করে শক, হুন, পাঠান, মুঘল যেমন এদেশে এসেছে, তেমনি ভারতীয়রা গিয়ে পৌঁছেছে মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন জায়গায়।

গ. দ্বিতীয়ত, ভারতের প্রায় মধ্যভাগে অবস্থিত বিন্ধ্যপর্বত-ও ভারত-ইতিহাসকে প্রভাবিত করেছে। ভারতের মধ্যভাগে দাঁড়িয়ে থেকে বিন্ধ্যপর্বত যেন ভারতকে উত্তর ও দক্ষিণ, দুটি সুস্পষ্ট ভূখণ্ডে বিভক্ত করে রেখেছে। বিন্ধ্যপর্বতের বাধা অতিক্রম করে প্রাচীন এবং মধ্যযুগের খুব কম রাজাই দক্ষিণে উপস্থিত হতে পেরেছিলেন উত্তর ভারত থেকে। ব্যতিক্রম ছিলেন মৌর্য এবং গুপ্তরা। সুলতানদের মধ্যে আলাউদ্দিন খলজির আগে কেউ-ই দক্ষিণে পদার্পণ করেননি।

ঘ. তৃতীয়ত, ভারত-ইতিহাসে নদনদী, প্রভাব-ও উল্লেখযোগ্য। প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য থাকা সত্ত্বেও ভারতবর্ষ মূলত নদীমাতৃক দেশ। ভারতের মাটিকে উর্বর করে তার ফলন ক্ষমতা বাড়াতে যেমন নদ-নদী সাহায্য করেছে, তেমনি নদীর পারে গড়ে উঠেছে রাজধানী নগরী, বাণিজ্য নগরী বা বন্দর। রাজধানী নগরীকে সুরক্ষিত করতেও নদ-নদীর ভূমিকা অনেকখানি। গঙ্গা ও শোন নদীর সঙ্গমে অবস্থিত পাটলিপুত্র ছিল অনেকটা জলদুর্গের মতো।

ঙ. চতুর্থত, ভারতের প্রাকৃতিক পরিবেশের অনেকখানি জুড়ে আছে সমুদ্র। তিনদিকে সমুদ্র বেষ্টিত ভারতীয় উপদ্বীপ যে স্বাভাবিক নিরাপত্তা পেয়েছে তেমন আর খুব কম দেশ- ই লাভ করেছে। সমুদ্রে নিরাপত্তা থাকবার ফলে ভারতবর্ষকে কোনও কালেই সামুদ্রিক অভিযানের সম্মুখীন হতে হয়নি। বরঞ্চ ভারতীয়রা-ই বহির্দেশে সামুদ্রিক অভিযান চালিয়ে সফল হয়েছিল, যেমন চোলরা। আবার সমুদ্রপথে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন। সেই সঙ্গে ভারতীয় সংস্কৃতি ও পৌঁছে গিয়েছিল ঐসব দেশে। এইভাবে বলা যায় যে, ভারতীয় সভ্যতা, রাজনীতি, অর্থনীতি, সবকিছুই ভৌগোলিক পরিবেশের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। 

 প্রশ্ন : ভারতীয় ইতিহাসে মূলগত ঐক্যের কারণ কি?

অথবা ভারতীয় সভ্যতার মূলগত ঐক্য বলতে কি বোঝ?

উত্তর:  (a) সূচনা: ভারতীয় সভ্যতা বৈচিত্র্যময়। এই বৈচিত্র্য ধরা পড়ে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের বেশভূষা, আচার-ব্যবহার, খাদ্য-পানীয় বা পূজা পদ্ধতির বিভিন্নতায়। উত্তর ভারতের মানুষের সঙ্গে দক্ষিণ ভারতীয়দের যতখানি পার্থক্য, পূর্ব এবং পশ্চিমের মানুষের মধ্যে তফাত তার চেয়ে কম কিছু নয়। সাধারণ চোখে ভারতীয়দের মধ্যে যে বিভিন্নতা তা-ই ধরা পড়ে। মনে হয় যেন বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মধ্যে অমিল-ই বেশি। কিন্তু একটু গভীরভাবে বিচার করলে এই বক্তব্যের অসারতা প্রমাণিত হবে। উদাহরণ দিয়ে ভারতীয়দের মূলগত ঐক্যের ধারণাকে প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব।

(b) প্রথমত, প্রাচীনকাল থেকেই ভারতীয় মনীষীরা ভারতীয় উপমহাদেশকে একটি অখণ্ড রাষ্ট্র বা দেশ হিসাবে বিবেচনা করেছেন। 'ভারতবর্ষ' বলতে তাঁরা বুঝিয়েছেন গোটা দেশ, আজ যাকে আমরা ভারত’ বা 'ইন্ডিয়া' বলে জানি।

(c) দ্বিতীয়ত, প্রাচীনকালের রাজা-মহারাজাদের কল্পনায় বা মুঘল সম্রাটদের ধারণায় 'ভারতবর্ষ বলতে উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে কন্যাকুমারিকা পর্যন্ত ভূখণ্ডকে-ই বুঝতেন।

(d) তৃতীয়ত, ভারতে প্রচলিত অধিকাংশ ভাষার বনিয়াদ প্রাচীনকালের সংস্কৃত ভাষায় রচিত। একথা অস্বীকার করা যায় না যে, আজকের দিনে হিন্দীকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে চালু করতে আইনের প্রয়োজন হয়েছিল। কিন্তু স্বাভাবিক নিয়মেই অশোকের আমলে প্রাকৃত ভাষা রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা লাভ করেছিল। ঐক্যের ধারণা ব্যতীত তা মোটেই সম্ভবপর হত না।

(e) চতুর্থত, অন্তর্নিহিত আদর্শের দিক দিয়েও ভারতবাসীর একতা প্রমাণিত হয়। পারিবারিক বন্ধনকে মর্যাদা দেওয়া, গুরুজনকে শ্রদ্ধা করবার আদর্শ ভারতবাসীমাত্রেরই আদর্শ। আবার মাতা এবং মাতৃভূমির স্থান যে সকলের উঁচুতে, সেই আদর্শ ভারতবর্ষের সকল মানুষের নিকট সমানভাবে আদৃত।

(f) পঞ্চমত, নানা ভাষা, নানা মত, নানা পরিধান সত্ত্বেও ভারতীয়দের একতা যে বর্তমান তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ মেলে এদেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে। ভারতবাসীর মধ্যে যে বৈচিত্র্য লক্ষণীয় তা ইওরোপের বিভিন্ন জাতির সঙ্গে তুলনীয়। কিন্তু এইসব বিভিন্ন জাতির মানুষ মিলে আবহমান কাল থেকে যে সভ্যতা ও সংস্কৃতি গড়ে তুলেছে তা অদ্বিতীয়। পৃথিবীতে তার তুলনা আর নেই বললেই চলে। বেদ, রামায়ণ, মহাভারত ভারতের সর্বত্র-ই সমভাবে সানন্দে গৃহীত। এই ধরনের সাংস্কৃতিক ঐক্য হিন্দুদের একই সূত্রে গ্রথিত করলেও অপর এক সাংস্কৃতিক ঐক্য বিভিন্ন ধর্মের মানুষকে নিয়ে গড়ে উঠেছে। ভারতের হিন্দু, মুসলমান, খ্রীস্টান, বৌদ্ধ, পার্সী সকলেই একই ভারত-মাতার সন্তান হিসাবে দেশের সফলতা ও ব্যর্থতার অংশীদার। আর সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে পরস্পরের দ্বারা প্রভাবিত হওয়া তো স্বাভাবিক ব্যাপার।

সুতরাং একথা দ্বিধাহীনভাবে বলা যায়, ভাষাই হোক, ধর্মই হোক বা সঙ্গীত, সাহিত্য, শিল্পকলা, নৃত্যানুষ্ঠান, সামগ্রিক আচার-আচরণ যেদিক থেকেই হোক, সারা ভারতের পূর্ব থেকে পশ্চিম, উত্তর থেকে দক্ষিণ, সর্বত্রই এক ঐক্যবোধ অন্তঃসলিলা ফল্গুধারার মত বিরাজমান থেকে দেশকে ঐক্য সূত্রে প্রথিত করেছে। 


Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.