জৈনধর্ম ও বৌদ্ধধর্ম | Buddhism and Jainism (PART-2)

 


১। জৈনধর্ম এবং বৌদ্ধধর্মে পার্থক্য এবং মিল কি কি বিষয়ে তা সংক্ষেপে লেখ । 

উত্তর :  জৈনধর্ম এবং বৌদ্ধধর্ম প্রায় সমসাময়িক । একই পারিপার্শ্বিক অবস্থার মধ্যে উভয় ধর্মের সৃষ্টি হয়েছিল । যে কারণে উভয় ধর্মের মধ্যে মিল থাকা খুবই স্বাভাবিক। আবার উভয়ের মধ্যে কোনও কোনও বিষয়ে অমিল যে নেই তা নয় ।

প্রথমত, জৈনধর্মের প্রবক্তা মহাবীর এবং বৌদ্ধধর্মের প্রতিষ্ঠাতা গৌতম বুদ্ধ উভয়েই ছিলেন ক্ষত্রিয় বংশ উদ্ভূত অর্থাৎ তারা দুজনেই ধর্ম-বিষয়ে ব্রাহ্মণদের একচেটিয়া আধিপত্য ভঙ্গ করে ক্ষত্রিয়দের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছিলেন দ্বিতীয়ত, ব্রাহ্মণ্যধর্মে যে জীবহত্যা সেসময়ে প্রচলিত ছিল তাকে বর্জন করেছিল জৈন এবং বৌদ্ধধর্ম জৈনধর্ম এবং বৌদ্ধধর্ম উভয়েই ছিল অহিংসার উপর প্রতিষ্ঠিত । তৃতীয়ত, অহিংসা ব্যতীত সৎ-জীবনযাপনের উপর মহাবীর এবং গৌতম বুদ্ধ গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন তাছাড়া জৈনধর্ম এবং বৌদ্ধধর্মে জাতিভেদ স্বীকৃত নয় । চতুর্থত, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নানাবিধ প্রভাবে জৈনধর্ম যেমন রূপান্তরিত হয়েছিল, তেমনি বৌদ্ধধর্মেও নানাবিধ পরিবর্তন এসে গিয়েছিল ।

উপরের আলোচনাতে যে সাদৃশ্যের কথা বলা হয়েছে তা সত্ত্বেও জৈনধর্ম ও বৌদ্ধধর্মে যে বৈসাদৃশ্য বা অমিল একেবারে ছিল না তা নয়। নানা ক্ষেত্রে উভয়ের অমিল লক্ষ্য করা যায় । প্রথমত, জৈনধর্ম ভারতের বাইরে প্রচারিত হয়নি, কিন্তু বৌদ্ধধর্ম ভারতের বাইরে বিভিন্ন দেশে যথেষ্ট জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল । দ্বিতীয়ত, জৈনধর্মে অহিংসার ব্যাপক প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায় । অর্থাৎ জৈনরা বিশ্বাস করতেন যে পাথর বা তরুলতাতেও প্রাণ আছে ; সেইহেতু ঐসবকে আঘাত করা উচিত নয় । বৌদ্ধরা অহিংসাতে বিশ্বাসী হলেও তার প্রয়োগ এত ব্যাপকভাবে করেননি । তৃতীয়ত, জৈনরা আত্মার চরম মুক্তি পাবার আশায় তপস্যায় বিশ্বাসী। অর্থাৎ সংসার ধর্ম পালন থেকে বিরত থেকে জৈনরা আত্মার মুক্তি ঘটাতে চান ৷ কিন্তু বৌদ্ধরা বিশ্বাস করেন যে সংসারধর্ম পালনের পরেও মানুষের ‘নির্বাণ’ লাভ সম্ভব। এইভাবে জৈনধর্ম ও বৌদ্ধধর্মের মধ্যে সাদৃশ্য এবং বৈসাদৃশ্য উভয়-ই লক্ষণীয়।

২। প্রশ্ন : প্রবন্ধ রচনা কর : খ্রীস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের প্রতিবাদী আন্দোলন।

ক. সূচনা :  খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের মধ্যে উত্তর ভারতের সর্বাঙ্গীণ জীবনে পরিবর্তন দেখা দিয়েছিল। এই পরিবর্তন কেবল রাজনৈতিক নয়, সামাজিক বা অর্থনৈতিক অবস্থারও অদল-বদল ঘটিয়ে দিয়েছিল। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে পরিবর্তনের মূল কথা শক্তিশালী রাষ্ট্রের গঠন, নগরের উত্থান প্রভৃতি। অর্থনৈতিক পরিবর্তনের কারণ ছিল কৃষি-উৎপাদনের প্রাচুর্য, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার প্রভৃতি। আর সামাজিক ক্ষেত্রে নতুন সামাজিক শ্রেণীর বিকাশ ইতিপূর্বেকার সামাজিক সমতাকে ক্ষুণ্ণ করেছিল। এইভবে সর্বক্ষেত্রে যে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে গিয়েছিল তার সঙ্গে সমসাময়িক বৈদিক ব্রাহ্মণ্যধর্ম আর খাপ খাওয়াতে পারেনি। অর্থাৎ সর্বক্ষেত্রে পরিবর্তন ধর্মীয় পরিবর্তনকে অবশ্যম্ভাবী করে তুলেছিল। জন্ম নিয়েছিল ধর্মীয় ক্ষেত্রে প্রতিবাদী আন্দোলন।

খ্রীস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে যেসব প্রতিবাদী ধর্ম আন্দোলন জন্ম নিয়েছিল তাদের মধ্যে জৈনধর্ম এবং বৌদ্ধধর্ম প্রধান। প্রতিবাদী আন্দোলন বলতে বোঝায় সমসাময়িক উত্তর ভারতে প্রচলিত সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং ধর্মীয় ব্যবস্থার প্রতিবাদ হিসাবে যে আন্দোলন সৃষ্টি হয়েছে। বৈদিক যুগের শেষ দিকে ব্রাহ্মণ্য ধর্মে নানা প্রকার জটিলতা ঢুকে পড়েছিল। অর্থাৎ ব্রাহ্মণ্যধর্ম আচার-অনুষ্ঠানসর্বস্ব হয়ে পড়ে। ধর্মে যাগ যজ্ঞ, বলিদান প্রভৃতি গুরুত্ব পায়। এই ধরনের জটিলতা সাধারণ মানুষের পক্ষে ধর্মপালনে অসুবিধার  সৃষ্টি করে। এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটিয়েছিল নতুন ধর্মান্দোলন। এই সূত্রে জন্ম নিয়েছিল ৬৩টি নতুন ধর্মমত যার মধ্যে জৈনধর্ম ও বৌদ্ধধর্ম প্রধান আধুনিক গবেষণায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, বৈদিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রতিবাদ হিসাবে প্রতিবাদী ধর্মের সৃষ্টি হলেও এর পেছনে গভীর সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং ধর্মীয় কারণ ছিল। সামাজিক পরিবর্তন অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে অনেকখানি যুক্ত বলে তার আলোচনা প্রথমে করা যেতে পারে।

খ. অর্থনৈতিক :  প্রতিবাদী আন্দোলনের প্রধান অর্থনৈতিক কারণ হিসাবে বলা যায় খ্রীস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকের মধ্যে গাঙ্গেয় উপত্যকায় কৃষিকাজের ব্যাপকতা। লোহার আবিষ্কারের পরে এই সময়েই তার ব্যাপক প্রচলন হয়। লোহার তৈরী কাস্তে, লাঙ্গল, নিড়ানি প্রভৃতির সাহায্যে শক্ত জমিকে চাষ উপযোগী করে তোলা সম্ভব হয়েছিল। তাছাড়া চারা ধান গাছকে এক জায়গা থেকে অপর জায়গায় স্থানান্তরিত করে রোপণ-পদ্ধতি আয়ত্ত করবার ফলে শস্যফলন বেড়ে গিয়েছিল। আবার কৃষিকাজ বৃদ্ধি পাওয়ায় বলিবর্নের (বলদ) প্রয়োজন হয়েছিল আগেকার চেয়ে অনেক বেশি। ব্রাহ্মণ্যধর্মে প্রচলিত যাগযজ্ঞে পশুবলি দেওয়া হত বলে সমাজে তখন গো-সম্পদ রক্ষা করবার তাগিদ দেখা দেয় । কৃষিকাজে উন্নতির ফলে আবার সমাজে নতুন এক বিত্তশালী সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয় । নগরে বসবাসকারীদের অনেকেও আবার ব্যবসা-বাণিজ্যে উন্নতি করে বিত্তবান হয়ে ওঠে। এইভাবে বিত্তশালী এবং সাধারণ গরীবদের মধ্যে পার্থক্য ১ দেখা দিয়েছিল। দরিদ্র মানুষ তাদের দুর্দশার জন্য ব্রাহ্মণ্যধর্মকে দায়ী করে যেন নতুন ধর্মের জন্য আকুল হয়ে উঠেছিল।

গ. সামাজিক : সামাজিক দিক দিয়ে বৈদিক যুগের শেষভাগে চার বর্ণের মানুষ এক রকম পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল । ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্র, এই চার শ্রেণীর মধ্যে সামাজিক মর্যাদার অনেক তফাৎ ছিল । ব্রাহ্মণরা সবচেয়ে উঁচুতে, তারপরে ক্ষত্রিয়রা। বৈশ্যদের অধিকার বলতে কিছু ছিল না। আর শূদ্ররা তো ছিল অচ্ছুৎ । এইভাবে যে সামাজিক প্রভেদ তাতে প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিল অর্থাৎ ক্ষত্রিয়রা নিজেদের ব্রাহ্মণদের সমান সামাজিক মর্যাদা দাবি করতে না হলেও ক্ষত্রিয়রা থাকে । যার জন্য দেখা যায় তারা ধর্মের ব্যাপারে ব্রাহ্মণদের আধিপত্য কেড়ে নিতে উদ্যোগী হয়েছে। খ্রীস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে প্রতিবাদী সব ধর্মীয় আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ক্ষত্রিয়রা । মহাবীর, গৌতম বুদ্ধ প্রভৃতি সকলেই ছিলেন ক্ষত্রিয় বংশজাত ।

ঘ. ধর্মীয় : অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে যে সংকট দেখা দিয়েছিল তা ধর্মকে প্রভাবিত করেছিল অনিবার্যভাবেই । উত্তর ভারতে সেযুগে ব্রাহ্মণ্যধর্মের আওতার বাইরে মুনিঋষিদের এক পরম্পরা বা ঐতিহ্য বিদ্যমান ছিল । তপস্বী মুনিঋষিরা হিমালয়ের বনে-জঙ্গলে বা নির্জনে একাকী কোনও জায়গায় বসবাস করতে পছন্দ করতেন। মাঝেমধ্যে তাঁরা লোকালয়ে যখন আসতেন তখন তাদের সরল, অনাড়ম্বর, জাতিভেদহীন জীবন-পদ্ধতি সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করত । মুনিঋষিদের জীবের প্রতি দয়া এবং অহিংসার আদর্শ সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করেছিল । মানুষ তখন যাগযজ্ঞের অসারতা, হিংসার অপ্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছিল। সহজ, সরল, অহিংস ধর্ম পালনের জন্য আকুল হয়ে উঠেছিল ।

৩। প্রশ্ন: গৌতম বুদ্ধের জীবনী ও বাণী'—এই শিরোনামে একটি প্রবন্ধ রচনা কর। 

উত্তর: ক. সূচনা :  আধুনিককালে মনীষীবৃন্দ গৌতম বুদ্ধকে বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মানব বলে স্বীকার করে নিয়েছে। বক্তৃতপক্ষে চরিত্র ও জ্ঞানে, ত্যাগ ও মানবহিতৈষণায় গৌতম বুদ্ধ বিশ্বের দরবারে এক অতি উচ্চ আসনে প্রতিষ্ঠিত। গৌতম ছিলেন রাজপুত্র। ভোগবিলাস ও প্রাচুর্যের কোন কমতি ছিল না  তার জীবনে। তথাপি একদিন গভীর রাত্রে মানুষের দুঃখ দূর করবার উদ্দেশ্যে তিনি রাজপ্রাসাদ ছেড়ে পথে নেমে এসেছিলেন। কারণ জাগতিক ভোগবিলাস, রাজসম্পদ কোন কিছুই তাঁকে মুক্তির পথের সন্ধান দিতে পারেনি। তাই তিনি সকল মানুষের দুঃখ-দুর্দশা মোচনের সংকল্প নিয়ে বসেছিলেন তপস্যায়। সেই তপস্যায় ছিল না মানুষে মানুষে ভেদাভেদ না ছিল কারো প্রতি বিদ্বেষ। কেবল ছিল সকল মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসা।

খ. বুদ্ধত্ব লাভের আগে গৌতমের জীবন : বাল্যকালে সিদ্ধার্থেরই অপর নাম ছিল গৌতম। হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত (বর্তমান নেপালের অন্তর্গত) কপিলাবস্তু রাজ্যের শাক্যনেতা শুদ্ধোধন ছিলেন সিদ্ধার্থের পিতা। শাক্যনেতার মর্যাদা অনেকটা ছিল রাজার মত-ই। তাই সিদ্ধার্থ বা গৌতম রাজপুত্র হিসাবেই লালিত পালিত হয়েছিলেন। তাঁর জন্য ভোগবিলাসের অফুরন্ত আয়োজন ছিল। ঐশ্বর্য ও সম্পদের প্রাচুর্য সত্ত্বেও সিদ্ধার্থ তাতে মেতে উঠতে পারেননি। কারণ মানবহিতৈষণা এবং মানবমুক্তির চিন্তা তাঁকে বাল্যকাল থেকেই পেয়ে বসেছিল।

সিদ্ধার্থ একজন গৃহী মানুষ হিসাবেই সংসার জীবন শুরু করেছিলেন। সিদ্ধার্থের মধ্যে বৈরাগ্যের ভাব লক্ষ্য করে পিতা শুদ্বোধন তাঁকে সংসার জীবনে জড়িয়ে রাখতে চেয়েছিলেন। অল্প বয়সে তাঁর বিবাহ হয়, এবং পুত্র-সস্তান রাহুল'এর জন্ম হয়। কিন্তু এতসব সত্ত্বেও সংসারবন্ধনে তিনি আবদ্ধ থাকতে পারেননি। একদিন তিনি গৃহত্যাগ করে বেরিয়ে পড়েছিলেন মানুষের মুক্তির সন্ধানে। স্ত্রী-পুত্র, পিতা-মাতা, পরিবার পরিজন সবাইকে ছেড়ে দিয়ে তিনি যে বেরিয়ে পড়েছিলেন তাতে গোপনীয়তা কিছু ছিল —সকলের জ্ঞাতসারেই তিনি গৃহত্যাগ করেছিলেন।

গ. গৌতমের বোধিলাভ : একথা সকলেরই জানা আছ যে, গৌতম গৃহত্যাগের পরে বিভিন্ন স্থান পরিভ্রমণ করেছিলেন, এবং শেষ পর্যন্ত তিনি তপস্যার দ্বারা সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। তপস্যায় সিদ্ধিলাভ করেই তিনি ‘গৌতম বুদ্ধ’ নামে পরিচিত হন। কিন্তু এই তপস্যা করতে গিয়ে তাঁকে যে অনেক পরিশ্রম ও নানা অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল তা ভাবলে আশ্চর্যান্বিত হতে হয়।

গৃহত্যাগের পরে প্রথমে তিনি আত্মার মুক্তির সন্ধানে জনৈক সন্ন্যাসী আলম কালামের নিকট ধ্যানের প্রক্রিয়া শিক্ষা করেন। কিন্তু সেই শিক্ষা গৌতমকে প্রকৃত পথের সন্ধান দিতে পারেনি। অতঃপর তিনি শ্রাবস্তী নগরীতে জনৈক উদ্রক রামপুত্রের কাছে কিছুদিন শিক্ষালাভ করেন। কিন্তু তাতেও তিনি তাঁর ঈপ্সিত বস্তু লাভ করেননি। হটযোগ, রাজযোগ প্রভৃতির মাধ্যমে গৌতম তার লক্ষ্যে পৌছাবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছিলেন। এইভাবে বিফলকাম হয়ে তিনি শেষ পর্যন্ত ধ্যানমগ্ন হবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। প্রথমে কিছুদিন গয়ার নিকটবর্তী একটি পাহাড়ে বসবাস করবার পরে নৈরঞ্জনা নদীর তীরে অবস্থিত উরুবি গ্রামে এসে উপস্থিত হন, এবং সেখানে একটি অশ্বত্থ গাছের নীচে ধ্যানমগ্ন হন।

ধ্যানমগ্ন অবস্থায় দীর্ঘদিন কাটাবার পরে একদিন তার এমন অনুভব হয়েছিল যেন তিনি জগতের সব সত্য বুঝতে পেরেছেন। তিনি বোধ করলেন যেন তাঁর সকল দুঃখের অবসান ঘটেছে, তিনি ‘নির্বাণ’ ও পরম আনন্দ লাভ করেছেন। সেই সময় থেকেই গৌতম ‘বুদ্ধ’ নামে পরিচিত। যিনি পরমজ্ঞান বা বোধিলাভ করেন, তিনিই বুদ্ধ।

ঘ. গৌতম বুদ্ধের ধর্মচক্রপ্রবর্তন : গৌতম যে পরমজ্ঞান লাভ করেছিলেন তা অনুভব করবার বস্তু— সহজে তা দর্শন করা যায় না, বা বোধ করা যায় না। গৌতম বুদ্ধ স্বয়ং এক জায়গায় বলেছিলেন যে, এই ধর্ম গভীর, কঠিন এবং তর্কের অতীত, একমাত্র জ্ঞানী ব্যক্তিরাই পারেন তাকে উপলব্ধি করতে। বোধিলাভ করে গৌতম বুদ্ধ যে জ্ঞান ও আনন্দ লাভ করেছিলেন তা তিনি নিজেই কেবল উপভোগ করবেন না সকলকে তিনি তা বিলিয়ে দেবেন, এই নিয়ে তিনি কিছু বিভ্রান্তিতে পড়েছিলেন। অর্থাৎ তার উপলব্ধির কথা সকলকে জানাবেন কিনা, বা তা প্রচার করবেন কিনা এই ব্যাপারে তিনি মনস্থির করতে পারেননি প্রথমে। শেষ পর্যন্ত তিনি সাধারণ মানুষকে অজ্ঞানতা থেকে মুক্ত করবার পথই বেছে নিয়েছিলেন। সর্বপ্রথম গৌতম বুদ্ধ সারনাথে পঞ্চভিক্ষুর কাছে তার উপলব্ধির কথা বুঝিয়ে বলেছিলেন। এইভাবেই শুরু হয়েছিল ‘ধর্মচক্রপ্রবর্তন। অর্থাৎ ধর্মের রাজত্ব বা ধর্মের রাজ্যের সূচনা বা প্রবর্তন করেছিলেন।

ঙ. গৌতম বুদ্ধের বাণী : গৌতম বুদ্ধের প্রচারিত ধর্ম কতকগুলি মূল সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত। তাঁর বক্তব্য অনুসারে মানুষ জরা, ব্যাধি প্রভৃতি দুঃখ-কষ্ট যে ভোগ করে থাকে তার কারণ হল তারা নানাপ্রকার লোভ বা আকাঙক্ষার শিকার হয়। অর্থাৎ লোভ বা আকাঙক্ষা থেকেই দুঃখ-কষ্টের সৃষ্টি। লোভের ফলে মানুষের আত্মার অবনতি ঘটে, এবং মানুষ জন্ম-জন্মান্তর ধরে দুঃখ-কষ্ট ভোগ করে থাকে। বুদ্ধদেবের নির্দেশ হল, মানুষ যদি সৎপথে থেকে আত্মার চরম মুক্তি বা ‘নির্বাণ' লাভ করে তাহলে তার আর পুনর্জন্ম ঘটবে না। আর পুনর্জন্ম না ঘটলে পার্থিব সব দুঃখ কষ্টের হাত থেকে সে রেহাই পাবে। বুদ্ধদেব তাই নির্বাণ বা মুক্তিলাভের জন্য চারটি পরমসত্য উপলব্ধির কথা বলেছেন। এই চারটি পরমসত্যকে বলা হয় ‘আর্যসত্য’ । যথা : ক. জগৎ দুঃখময়, খ. দুঃখ আসে লোভ বা আকাঙ্ক্ষা থেকে গ. আকাঙ্ক্ষার নিবৃত্তি বা বিনাশ হলে মুক্তি সম্ভব, এবং ঘ. আকাঙক্ষা বিনাশের জন্য ‘অষ্টাঙ্গিক মার্গ’ বা আটটি পথ অনুসরণ করতে হবে। এই আটটি পথ হল : সৎ কাজ, সৎ চিন্তা, সৎ আলাপ, সৎ জীবন, সৎ ব্যবহার, সৎ আকাঙ্ক্ষা, সৎ চেষ্টা এবং সৎ মনোবৃত্তি।

বৌদ্ধধর্মের সরল আদর্শের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে প্রাচীন ভারতের অনেক জ্ঞানী-গুণী মানুষ ও নৃপতি ঐ ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। বহির্ভারতেও বৌদ্ধধর্মের প্রসার ঘটেছিল। সবচেয়ে বড় কথা হল, বৌদ্ধধর্ম ভারতীয় সভ্যতা-সংস্কৃতিকে নানাভাবে পরিপুষ্ট করেছিল।


Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.