রাজনৈতিক ঐক্যের যুগ | The era of political unity (PART-1)

রাজনৈতিক ঐক্যের যুগ | The era of political unity (PART-1)

 

১. প্রশ্ন : ষোড়শ মহাজনপদ (Sixteen Mahajanapadas)  সম্বন্ধে টীকা লেখ ।

উত্তর : গৌতম বুদ্ধের সমসাময়িক উত্তর ভারতে ১৬টি রাজ্য গড়ে উঠেছিল যেগুলিকে ‘মহাজনপদ’ বলা হয় অর্থাৎ ১৬টি মহাজনপদ অর্থে ‘ষোড়শ মহাজনপদ’ । এই রাজ্যগুলির অবস্থান ছিল বিন্ধ্যপর্বতের উত্তরে এবং ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত থেকে বিহারের মধ্যে । ষোড়শ মহাজনপদের মধ্যে মগধ, কোশল, বৎস এবং অবস্তী, এই চারটি রাজ্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল । এই চারটি রাজ্য সর্বদা পরস্পর বিবাদে নিজেদের শক্তি ক্ষয় করছিল । তারপরে এক সময় মগধ অপর তিনটিকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গিয়েছিল । কেবল তা-ই নয় মগধকে কেন্দ্র করেই ভারতে প্রথম সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল। মগধের রাজধানী ছিল পাটলিপুত্র ।

২। প্রশ্ন : মগধের উত্থানের কারণ কি ?

উত্তর :  ষোড়শ মহাজনপদ যুগের রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য ছিল পরস্পরের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা। অবন্তী, মগধ, বস এবং কোশল, প্রধানত এই চারটি রাজ্যের মধ্যে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছিল। সর্বদাই তাদের মধ্যে যুদ্ধবিগ্রহ লেগে থাকত। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জয় হয়েছিল মগধের । কারণ মগধের ভৌগোলিক অবস্থান ছিল সুবিধাজনক বাইরে থেকে শত্রুপক্ষ এসে সহজে মগধ আক্রমণ করবার সুযোগ পেত না। তাছাড়া মগধ অঞ্চলের উর্বর পলিমাটিতে প্রচুর পরিমাণ ফসল উৎপন্ন হত বলে মগধের আর্থিক অবস্থা ছিল খুবই শক্তিশালী। তাছাড়া মগধ অঞ্চলে লোহার আকর পর্যাপ্ত পরিমাণ পাওয়া যেত বলে মগধের পক্ষে যুদ্ধের জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র তৈরী করা কঠিন হয়নি । অপর পক্ষে অপরাপর জনপদসমূহে এসবের সুযোগ ছিল না বলে তারা কেউ-ই মগধকে আটকাতে পারেনি।

৩। প্রশ্ন : টীকা লেখ : মেগাস্থিনিস ।

উত্তর : আলেকজাণ্ডারের অন্যতম সেনাপতি যিনি তাঁর মৃত্যুর পরে উত্তরাধিকারী হিসাবে সাম্রাজ্যের একাংশ পেয়েছিলেন তিনি সেলুকাস নিকাতর বা নিকেটার । সেলুকাস ছিলেন সীরিয়ার গ্রীকরাজা । তিনি চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সঙ্গে প্রথমে সংঘর্ষ এবং পরে বন্ধুত্ব স্থাপন করেন। পরস্পর মৈত্রীবন্ধনকে সুদৃঢ় করবার জন্য সেলুকাস মেগাস্থিনিস নামে জনৈক দূতকে মগধের রাজসভায় প্রেরণ করেন । তখন সিংহাসনে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত আসীন। মেগাস্থিনিস তার ভারত ভ্রমণের কাহিনী 'ইণ্ডিকা' নামক গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন । মৌর্যযুগের ইতিহাস রচনায় মেগাস্থিনিসের ‘ইণ্ডিকা’ একটি গুরুত্বপূর্ণ লিখিত উপাদান।

৪। প্রশ্ন : টীকা লেখ : কৌটিল্য ।

উত্তর : ‘অর্থশাস্ত্র’ নামে রাজনীতি বিষয়ক গ্রন্থের প্রণেতা কৌটিল্য, চাণক্য বা বিষ্ণুগুপ্ত নামেও পরিচিতি লাভ করেছেন । তিনি-ই আবার ছিলেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রধানমন্ত্রী । কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে যে মূল বিষয়টি আলোচিত হয়েছে তা রাজ্যশাসন পদ্ধতি । রাজা কিভাবে দেশ চালাবেন, তাঁর দায়িত্ব বা কর্তব্য-ই বা কি হওয়া উচিত এইসব বিষয়ে আলোচনা ব্যতীত অর্থশাস্ত্রে আছে আইন-ব্যবস্থা সম্পর্কে  বিস্তারিত বক্তব্য । অর্থশাস্ত্রের আলোচ্য বিষয়গুলোর অনেক কিছুই আজকের দিনে রাষ্ট্র কর্তৃক গৃহীত হয়েছে । মৌর্য শাসনপদ্ধতি সম্পর্কে জানতে গেলে অর্থশাস্ত্রের ওপর অনেকখানি নির্ভর করতে হয়।

৫. প্রশ্ন : ফা-হিয়েন (Fahien) সম্বন্ধে সংক্ষেপে লেখ ।

উত্তর : বৌদ্ধ তীর্থস্থান দর্শন এবং বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্র সম্পর্কে জানবার আগ্রহ নিয়ে যাঁরা ভারতবর্ষে এসেছিলেন ফা-হিয়েন তাদের অন্যতম প্রধান । তিনি গুপ্তসম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজসভায় উপস্থিত হয়েছিলেন ‘ফো-কুয়ো-কিং’ গ্রন্থে ফা-হিয়েন তাঁর ভারত-ভ্রমণের অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করেছেন । বৌদ্ধধর্ম সংক্রাস্ত বিষয়গুলিতে তাঁর আগ্রহ বেশি থাকলেও ফা-হিয়েন ভারতীয় সমাজ এবং অর্থনীতি সম্পর্কে যে সমান আগ্রহী ছিলেন তা তাঁর ভ্রমণকাহিনী পড়লেই বোঝা যায় । ফা-হিয়েন এদেশে প্রচলিত জাতিভেদ প্রথার উল্লেখ করেছেন । তাছাড়া তিনি এ-ও উল্লেখ করেছেন যে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা জল এবং স্থলপথে বিদেশে পাড়ি দিতেন । ফা-হিয়েন তাম্রলিপ্তি (বর্তমান তমলুক) বন্দরের কথা বলতে ভোলেননি । 

৬. প্রশ্ন : মৌর্য শিল্পকলার একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দাও ।

উত্তর : মৌর্য শিল্পকলা বলতে মোটামুটিভাবে অশোকের আমলে উৎকীর্ণ শিলালিপি, স্তম্ভলিপি বা গুহালিপিতে খোদাই করা কারুকার্য-ই বোঝায় । স্থাপত্য-শিল্পের নিদর্শন তেমন কিছু আবিষ্কৃত হয়নি। অশোকের আমলের যেসব স্তম্ভ বা (ইংরেজীতে) পিলার আবিষ্কৃত হয়েছে তার কারুকার্য এবং উজ্জ্বলতা দেখলে বিস্মিত হতে হয় । 'অক্সফোর্ড হিষ্ট্রি অব ইণ্ডিয়া’র রচয়িতা ভিনসেন্ট স্মিথ বলেছেন যে, শক্ত পাথরের ওপরে পালিশ করার যে কায়দা শিল্পীরা আয়ত্ত করেছিল তা আজকের দিনে লুপ্ত একটি কলাশিল্প৷ তাছাড়া লৌড়িয় নন্দনগড়ে যে স্তস্ত আবিষ্কৃত হয়েছে তার গঠনশৈলী যেমন কারুকার্যময় তেমনি এতে ব্যবহৃত ধাতু-মিশ্রণ খুবই উন্নত মানের । যে কারণে স্তম্ভটির চকচকে পালিশ আজ-ও ক্ষুণ্ণ হয়নি । 

 ৭. প্রশ্ন : ‘গান্ধার শিল্প’ (Gandhar Art ) বলতে কি বুঝ ? 

উত্তর : কুষাণরা ভারতে এসেছিল মধ্য এশিয়া থেকে । ভারতে রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার পরে কুষাণ বংশীয় রাজারা এদেশের শিল্পকলা সহ সংস্কৃতির অন্যান্য শাখাতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন । কুষাণদের সঙ্গে যেসব শিল্পীরা এদেশে এসেছিলেন তারা পাশ্চাত্যের বিভিন্ন শিল্প-ঘরানার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন ।  এই সূত্রেই ভারতীয় শিল্পীরা গ্রীক-রোমান রীতির দ্বারা প্রভাবিত হন । উত্তর-পশ্চিম ভারতে গান্ধার কে কেন্দ্র করে ভারতীয় ও গ্রীক-রোমান শিল্পরীতির মিশ্রণে যে নতুন শিল্পরীতির সৃষ্টি হয় গান্ধার শিল্প বলতে তা-ই বোঝায় । গৌতম বুদ্ধের মূর্তি প্রথম এই গান্ধার শিল্পীরা-ই সৃষ্টি করেছিলেন । যেমন ছিল বিদেশী প্রভাবে গড়ে ওঠা শিল্প তেমনিভাবে আবার সম্পূর্ণ দেশীয় শিল্প ও গড়ে উঠেছিল কুষাণ আমলে । এই প্রসঙ্গে অমরাবতী ও মথুরার নাম স্মরণ করা যেতে পারে । 

৮।  প্রশ্ন : চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কৃতিত্ব আলোচনা কর ।

উত্তর : চন্দ্রগুপ্ত ছিলেন মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা । একজন সাধারণ মানুষের পক্ষে সে আমলেও সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন করা এক অসামান্য ব্যাপার ছিল । যতদূর জানা গিয়েছে তা থেকে বলা যায় যে, তিনি তাঁর মাতা মুরা’র নাম অনুসারেই মৌর্য সাম্রাজ্যের নামকরণ করেছিলেন। পার্বত্য জাতির লোকজন থেকে সৈন্যসামন্ত জোগাড় করে ধীরে ধীরে তিনি একের পর এক এলাকা দখল করে নেন। এইভাবেই গড়ে উঠেছিল মৌর্য সাম্রাজ্য। আর তার পিছনে যার কর্মক্ষমতা কাজ করেছিল তিনি চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য। অবশ্য চন্দ্রগুপ্ত চাণক্য নামে একজন কূটবুদ্ধি ব্রাহ্মণের সহযোগিতা ও সমর্থন লাভ করেছিলেন ।

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য নানা গুণসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন । তাঁর কৃতিত্বের প্রথমে রয়েছে গ্রীকশক্তিকে বিতাড়িত করে উত্তর-পশ্চিম ভারতকে বিদেশী শাসনমুক্ত করা। তারপরে তিনি ধননন্দকে মগধের সিংহাসন থেকে উচ্ছেদ করে তা নিজে দখল করে নেন । রাজনৈতিক দিক দিয়ে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য তৃতীয় আরও একটি বিষয়ে কৃতিত্বের অধিকারী হন তা ছিল সিরিয়ার গ্রীকরাজা সেলুকাস নিকাতরকে ভারতের মাটিতে পরাজিত করা (?)। সেলুকাস কাবুল, কান্দাহার, হিরাট এবং বেলুচিস্তান উপঢৌকন হিসাবে চন্দ্রগুপ্তকে দান করবার ফলে মৌর্য সাম্রাজ্যের সীমানা আরও বৃদ্ধি পেয়েছিল । চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য একজন সাম্রাজ্য নির্মাতা হিসাবে কাশ্মীর এবং কলিঙ্গ ব্যতীত সমগ্র উত্তর-ভারত নিজ দখলে এনেছিলেন। আর দক্ষিণে সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল মহীশূর পর্যন্ত । এত বড় সাম্রাজ্য চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের আগে আর কেউ-ই গঠনে সমর্থ হয়েছিলেন বলে জানা যায়নি। 

সাম্রাজ্য-নির্মাতা ছাড়া শাসক হিসাবেও চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কৃতিত্ব নিতান্ত কম নয় । কৌটিল্য প্রণীত অর্থশাস্ত্র গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, তিনি-ই প্রথম সাম্রাজ্যের সর্বত্র সুগঠিত শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পেরেছিলেন । যে-কারণে এ-বিষয়ে তাঁর আগ্রহের ঘাটতি ছিল না । চন্দ্রগুপ্ত প্রবর্তিত শাসনব্যবস্থায় রাজা সর্বক্ষমতার অধিকারী হলেও তিনি দেশের প্রচলিত রীতিনীতি মেনে চলতেন। তাছাড়া চন্দ্রগুপ্তর শাসনব্যবস্থায় প্রাদেশিক এবং গ্রাম-শাসনের উপর যথাযথ গুরুত্ব আরোপিত হয়েছিল। অল্পকথায় বলা যায় যে, চন্দ্রগুপ্ত যে শাসক হিসাবে দক্ষ ছিলেন তা স্পষ্ট বুঝা যায় তাঁর শাসনপদ্ধতির বৈশিষ্ট্যগুলি লক্ষ্য করলে এইভাবে দেখা যায় যে, নানা দিক থেকে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন । তিনি একাধারে ছিলেন সাম্রাজ্য-নির্মাতা এবং সংগঠক ।

৯. প্রশ্ন : মৌর্যসম্রাট অশোকের কৃতিত্ব আলোচনা কর ।

উত্তর : ক. সূচনা : মানুষ ও শাসক হিসাবে মৌর্যসম্রাট অশোক বিশ্বের সর্বকালের রাজাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ স্থান অধিকার করে আছেন । এই কথাই ফুটে উঠেছে মনীষী এইচ. জি. ওয়েলস’এর বক্তব্যে। তিনি অশোক সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন যে, আকাশে নক্ষত্রের মতো ইতিহাসের পৃষ্ঠায় যে শত-সহস্র রাজা ভিড় করে আছেন তাদের মধ্যে অশোক উজ্জ্বলতম বাস্তবিক পক্ষে কোন রাজার শ্রেষ্ঠত্ব যদি তাঁর জনহিতকর কাজকর্মের দ্বারা পরিমাপ করা হয় তাহলে অশোকের কাজের মোট পরিমাণ অন্যান্য রাজাদের তুলনায় অনেক অনেক বেশি । মহারাজ অশোক কেবল রাজকর্তব্য সম্পর্কে উচ্চ আশা ও আদর্শ-ই স্থাপন করেননি, সেই আদর্শকে নিজ জীবনে বর্ণে বর্ণে পালনও করেছিলেন।

খ। সম্রাট ও শাসক হিসাবে অশোক : মৌর্যসম্রাট অশোক একজন সম্রাট হিসাবে কীর্তিমান । তিনি ভারতের এক বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে রাজত্ব করেছিলেন । উত্তরাধিকারী হিসাবে প্রাপ্ত মৌর্যসাম্রাজ্যকে তিনি কেবল অটুট-ই রাখেননি, কলিঙ্গ রাজ্য জয় করে তাকে সুসংহত করেছিলেন এবং সাম্রাজ্যের নিরাপত্তাকে সুনিশ্চিত করেছিলেন । কলিঙ্গ রাজ্য সেই সময়ে দাক্ষিণাত্যে যাতায়াতের পথ নিয়ন্ত্রণ করতো বলে বর্তমান কর্ণাটক পর্যন্ত বিস্তৃত মৌর্য সাম্রাজ্যের পক্ষে তার অন্তর্ভুক্তি অপরিহার্য ছিল। 

একজন শাসক হিসাবেও অশোক কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন । তার আমলে মৌর্যসাম্রাজ্য বিশৃঙ্খলা থেকে মুক্ত ছিল। তাছাড়া সাম্রাজ্যের সর্বত্র কেন্দ্রীয় শাসনকে বলবৎ রাখতে গিয়ে তিনি কোন অসুবিধার সম্মুখীন হননি রাজকর্তব্য পালনের অঙ্গ হিসাবে তিনি বিচারের ব্যাপারে সমতাকে সুনিশ্চিত করেছিলেন। রাজকর্মচারীরা যাতে তাদের দায়িত্ব পালনে তৎপর থাকেন সে বিষয়েও অশোক সর্বদা নজর রেখেছিলেন।

গ. যুদ্ধনীতি বর্জন ও শাস্তির দূত : সাধারণভাবে দেখা যায় যে, যুদ্ধজয় যুদ্ধের স্পৃহাকে আরও বাড়িয়ে তোলে ৷ কিন্তু অশোকের কৃতিত্ব এখানেই যে কলিঙ্গ-বিজয় তাঁকে সাম্রাজ্যবাদী করে তুলতে পারেনি । কলিঙ্গ-যুদ্ধের ভয়াবহতা অশোককে চরমভাবে আঘাত করেছিল। শত-সহস্র মানুষের দুর্দশা প্রত্যক্ষ করে তিনি অনুশোচনাগ্রস্ত হয়েছিলেন। ভারাক্রান্ত মনে তিনি যুদ্ধ-বিগ্রহকে চিরতরে বিসর্জন দেবার সংকল্প গ্রহণ করেন । মহারাজ অশোকের কৃতিত্ব এইখানেই । কলিঙ্গ-যুদ্ধই ছিল অশোকের জীবনে প্রথম ও শেষ যুদ্ধ । অতঃপর তিনি চিরতরে যুদ্ধনীতিকে বর্জন করে মানবকল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন।

কলিঙ্গ-যুদ্ধ অশোকের মনে যে পরিবর্তন এনেছিল তার প্রকাশ ঘটেছিল অভ্যন্তরীণ ও পররাষ্ট্রনীতিতে। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে তিনি প্রজাদের মঙ্গলসাধনের জন্য নানাবিধ ব্যবস্থা অবলম্বন করেছিলেন। আর পররাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে, পার্শ্ববর্তী নৃপতিরা যেন অশোকের শক্তিকে আর ভয় না করেন । কারণ তিনি আর তাদের দুঃখের কারণ হবেন না শাস্তি ও মৈত্রীর মাধ্যমে তিনি তাঁদের সুখের কারণ হবেন। অর্থাৎ অশোক বহির্দেশীয় নৃপতিদের এই বলে আশ্বস্ত করেছিলেন যে, তিনি ভবিষ্যতে আর যুদ্ধনীতি অনুসরণ করবেন না - তাদের সঙ্গে মিত্রতা গড়ে তুলবেন শাস্তি ও অহিংসার মাধ্যমে।

ঘ. প্রজাদের মঙ্গলসাধন ও ধর্মপ্রচার : অশোকের কৃতিত্বের অপর একটি দিক হল, প্রজাদের মঙ্গলসাধনের জন্য শাসনব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটানো । অশোক তাঁর প্রজাদের সকলকে ‘নিজের সন্তান’ বলে ঘোষণা করেছিলেন ; এবং তাদের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক উন্নতি সাধনের জন্য সব রকমের ব্যবস্থা অবলম্বন করেছিলেন। রাজ্যের সর্বত্র রাজকর্মচারীরা যথাযথভাবে তাঁদের দায়িত্ব পালন করছেন কিনা, প্রজাসাধারণ কারো দ্বারা পীড়িত হচ্ছে কিনা তা লক্ষ্য করবার জন্য রাজুক, যুত নামে কর্মচারী নিয়োগ করেছিলেন। তাছাড়া ধর্মমহামাত্র নামে কর্মচারীরা প্রজাদের পারলৌকিক উন্নতি সাধনের জন্য ব্যাপৃত থাকতেন।

অশোকের ধর্মপ্রচার ছিল তাঁর জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কর্ম বৌদ্ধধর্মের মহিমা প্রচারের মাধ্যমে তিনি মানুষকে অহিংসা ও প্রেমের মন্ত্রে দীক্ষিত করতে চেয়েছিলেন। তাঁর বৌদ্ধধর্মের প্রচার কোন অনুগামীর সংখ্যাবৃদ্ধির উদ্দেশ্যের দ্বারা তাড়িত ছিল না। বিদেশেও অশোক দূত মারফৎ সেই অহিংসা ও মৈত্রীর বাণী প্রচার করেছিলেন। যার ফলে বিশ্বের দরবারে ভারতের গৌরব অনেক বৃদ্ধি পেয়েছিল।

এইভাবে বলা যেতে পারে যে, পৃথিবীর ইতিহাসে অশোকের মতো রাজার তুলনা পাওয়া দুষ্কর । শক্তিশালী রাজাদের মধ্যে সম্ভবত একমাত্র তিনিই উপলব্ধি করেছিলেন যে অহিংসা ও মৈত্রী, জনকল্যাণ প্রভৃতির মাধ্যমে যে প্রভাব বিস্তার করা সম্ভব তা হিংসার দ্বারা সম্ভব নয় ।

১০. প্রশ্ন : ইতিহাসে মৌর্যসম্রাট অশোকের স্থান নির্ণয় কর।

উত্তর : মৌর্যসম্রাট অশোকের কৃতিত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে বিখ্যাত মনীষী এইচ. জি. ওয়েলস বলেছেন যে, আকাশে নক্ষত্রের মতন ইতিহাসের পৃষ্ঠায় শত-সহস্র রাজা ভিড় করে আছেন তাঁদের মধ্যে অশোকের নাম উজ্জ্বলতর অর্থাৎ তার মতে, অশোক-ই হলেন শ্রেষ্ঠ রাজা । বাস্তবিকপক্ষে, রাজা হিসাবে অশোকের  কার্যকলাপের বিচার করলে দেখা যাবে যে তিনি এমন এক আদর্শ বিশ্ববাসীর সামনে তুলে ধরেছিলেন যা তখনকার দিনের মতো আজকের বিশ্বেও সমানভাবে গ্রহণীয় ।

মৌর্যসম্রাট হিসাবে অশোক এক বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে রাজত্ব করতেন । উত্তরাধিকারী হিসাবে প্রাপ্ত মৌর্য সাম্রাজ্যকে তিনি কেবল অটুট-ই রাখেননি কলিঙ্গ রাজ্য জয় করে তাকে সুগিঠতও করেছিলেন । কিন্তু কলিঙ্গ রাজ্য জয় তাঁকে সাম্রাজ্যবাদী করে তুলতে পারেনি। অশোক যুদ্ধনীতিকে চিরতরে বর্জন করেছিলেন । এইখানেই মহারাজ অশোকের মহত্ত্ব। একজন রাজা সাধারণত যুদ্ধজয়ে নতুন রাজ্য দখল করতে উৎসাহিত হন । কিন্তু অশোক এর ব্যতিক্রম। অতঃপর তিনি চিরতরে যুদ্ধকে বর্জন করে মানবকল্যাণে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন ।

অশোকের শ্রেষ্ঠত্বের আরও একটা দিক ছিল এই যে, তিনি দেশবিদেশে যে ধর্মপ্রচার করেছিলেন তার পিছনে কোনও স্বার্থ ছিল না। অহিংসা ও মৈত্রীর বাণী তিনি পৌছে দিয়েছিলেন দেশ-বিদেশের রাজা-মহারাজাদের । বিদেশে ধর্মপ্রচারের ক্ষেত্রে ইতিহাসে রাজা-মহারাজাদের সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, অশোক তরবারির সাহায্যে ধর্মপ্রচারে ব্রতী হননি যেমন অনেকে করেছিলেন। ভারতের অভ্যন্তরে প্রজাদের মঙ্গলসাধনের উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি মৌর্য শাসনব্যবস্থায় পরিবর্তন এনেছিলেন। ধর্মমহামাত্র, যুত প্রভৃতি কর্মচারীরা প্রজা কল্যাণের জন্য সর্বদা নিয়োজিত থাকতেন। 

অশোকের রাজত্বকালের সাংস্কৃতিক উন্নতিও উল্লেখের দাবি রাখে । তিনি স্তম্ভলিপি, শিলালিপি প্রভৃতি যে উৎকীর্ণ করিয়েছিলেন তা থেকে সে যুগের মানুষের শিক্ষাগত মানের পরিচয় পাওয়া যায় তাছাড়া লিপিসমূহের নির্মাণকৌশল থেকে সে যুগের স্থাপত্য-শিল্পের পরিচয় পাওয়া যায় । এইভাবে দেখা যায় যে, অশোকের আমলে সবদিক দিয়েই মৌর্য সাম্রাজ্য উন্নতি করেছিল । অশোক যে মহান আদর্শ নিয়ে দেশ-শাসনে ব্রতী হয়েছিলেন তেমন উদাহরণ আর পাওয়া দুষ্কর । অশোক প্রজামাত্রকেই তাঁর সন্তান বলে মনে করতেন। এইরূপ সর্বজনীন আদর্শ বিশ্বের আর কোনও নৃপতি কল্পনা করেছিলেন বলে জানা যায় না ।


Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.