1. প্রশ্ন : নিম্নলিখিত বিষয়ের ওপর প্রবন্ধ রচনা কর :
গুপ্তসাম্রাজ্যের পতনের কারণ ।
The cause of the fall of the Gupta Empire.
উত্তর : ক. সূচনা : গুপ্তসম্রাট সমুদ্রগুপ্ত এবং দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের অসাধারণ প্রতিভার ফলে যে বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল তা পঞ্চম শতকের শেষভাগ থেকে দ্রুত পতনের দিকে ধাবিত হয়। বস্তুত বুধগুপ্তের পরে আর কোনও গুপ্তসম্রাটই গঙ্গা এবং নর্মদা নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলের ওপর আধিপত্য বজায় রাখতে পারেননি। বলা বাহুল্য, গুপ্তবংশের দুর্বলতার জন্যই তা আর সম্ভব হয়নি। অবশ্য গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের জন্য আরও অনেক কারণই দায়ী ছিল। এই সূত্রে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় হুন আক্রমণের কথা। কোন কোন ঐতিহাসিক এমন পর্যন্ত বলেছেন যে, তুন আক্রমণের ফলেই পরাক্রান্ত গুপ্ত সাম্রাজ্য ভেঙ্গে খান খান হয়ে গিয়েছিল। তবে আধুনিক ঐতিহাসিকরা হুন আক্রমণকে গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের প্রধান বা একমাত্র কারণ বলে চিহ্নিত করতে রাজী নন। ড. রোমিলা থাপারের মতে হুন আক্রমণ তপ্তদের পতনকে ত্বরান্বিত করেছিল মাত্র। তিনি এমন পর্যন্ত বলেছেন যে, তুন আক্রমণের ঘটনা না ঘটলেও গুপ্ত সাম্রাজ্য আদৌ টিকে থাকত কিনা সন্দেহ। যাই হোক, নানা কারণের সমষ্টিগত ফল হিসাবেই গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতন ঘটেছিল।
খ. অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ : স্বন্দগুপ্তের পরবর্তী গুপ্তরাজরা সাম্রাজ্যের শক্তি এবং নিরা ত্তা রক্ষা করবার : মতো ক্ষমতা ধরতেন না। তাদের রাজত্বকালে তাই অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ যেমন দেখা দিয়েছিল, তেমনি বহিরাগত শত্রুরাও সুযোগ বুঝে সাম্রাজ্যের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কুমারগুপ্ত যখন সম্রাটপদে আসীন তখন পুষ্যমিত্র নামে এক দুর্ধর্ষ জাতি বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল। যুবরাজ স্কন্দগুপ্ত এদের পরাজিত করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু অকালের মধ্যেই হুনদের আক্রমণে পুনরায় গুপ্ত সাম্রাজ্য বিধ্বস্ত হয় ।
গ. হূন আক্রমণ : গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের জন্য ঐতিহাসিকদের অনেকে স্থূন আক্রমণকে বড় করেছিল দেখেছেন। একথা অনস্বীকার্য যে বৈদেশিক আক্রমণ সাম্রাজ্যকে যেভাবে আঘাত করেছিল তা সহজে কাটিয়ে ওঠা যায়নি । স্কন্দগুপ্ত বা নরসিংহগুপ্ত হুনদের পরাজিত করেছিলেন ঠিকই । কিন্তু হূন আক্রমণের এই আঘাত কাটিয়ে ওঠবার আগেই মালবের যশোধর্মন নিজেকে শক্তিশালী করে নিয়ে গুপ্তদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। যশোধর্মনের রাজত্বকাল খুব কম সময়ের জন্য হলেও তাঁর এই আক্রমণ গুপ্ত সাম্রাজ্যকে গভীরভাবে আঘাত করেছিল ।
ঘ. কেন্দ্রীয় শাসনের দুর্বলতা : গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের অপর একটি কারণ ছিল কেন্দ্রীয় শাসনের দুর্বলতার সুযোগে প্রাদেশিক শাসনকর্তা এবং সামন্তরাজদের স্বাধীনতা ঘোষণার ইচ্ছা। গুপ্ত সম্রাটদের অধীন বিভিন্ন এলাকায় যেমন, সমতট (বা দক্ষিণ-বঙ্গ), বিহার প্রভৃতি প্রদেশের শাসনকর্তা বা সামন্তরা শক্তিশালী হয়ে উঠে স্বাধীন রাজার মতো আচরণ করতে শুরু করেছিলেন। আর গুপ্তসম্রাটদের ক্ষমতা তখন এমন ছিল না যে তাঁরা আবার সেখানে ক্ষমতা প্রয়োগ করেন। এমতাবস্থায় গুপ্ত সাম্রাজ্য চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলার জন্য ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যেতে শুরু করেছিল ।
ঙ. সামরিক দুর্বলতা : গুপ্ত সাম্রাজ্য যে সামরিক কারণে ধ্বংস হয়েছিল তার মূল কথা ছিল নিজস্ব বাহিনীর অভাব । অর্থাৎ যুদ্ধকালে সৈন্য-সরবরাহের জন্য সর্বদা সামন্তদের উপর নির্ভরশীল থাকার ফলে। সুযোগ বুঝে এক সময় সামন্তরা সর্বেসর্বা হয়ে উঠেছিল। সামরিক এই দুর্বলতার পাশাপাশি অর্থনৈতিক দুর্বলতার কথাও উল্লেখ করতে হবে।
চ. অর্থনৈতিক দুর্বলতা : কুমারগুপ্তের পরবর্তী গুপ্ত রাজারা হুন আক্রমণ প্রতিরোধে তেমন সফলতা অর্জন করেননি । আবার সামন্তরাজাদের অনেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করায় গুপ্ত সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়েছিল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে শুরু করেছিল । গুপ্ত সাম্রাজ্যের অর্থনীতি ও সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছিল। বিভিন্ন সূত্র থেকে যা জানা গিয়েছে তার ভিত্তিতে বলা যায় যে, গুপ্ত শাসনের প্রথম দিকে কারিগর ও বণিক সংঘগুলো প্রশাসন-ব্যবস্থায় যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতো পরবর্তী কালে তাদের আর সেই ভূমিকা লক্ষ্য করা যায় না। তা থেকে এমন সিদ্ধান্ত করা যেতে পারে যে, কুমারগুপ্তের আমল থেকেই ব্যবসা-বাণিজ্যে ভাঁটা পড়েছিল । যার ফলে গোটা অর্থনীতিই দুর্বল হয়ে পড়েছিল ।
রেশম এবং মশলাপাতি, এই দুই ধরনের সামগ্রী ছিল ভারত-রোম বাণিজ্যের রপ্তানীর প্রধান উপকরণ। রোম সাম্রাজ্যের পতন এবং আরব দেশীয় বণিকদের হস্তক্ষেপের ফলে ভারতের বৈদেশিক বাণিজ্যে ভাঁটা শ পড়েছিল। আর তার পরিণতিতে গুপ্ত সাম্রাজ্য অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হতে থাকে। অর্থনৈতিক দুর্বলতার ফলে গুপ্ত সাম্রাজ্য যে পতনের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছিল তার প্রমাণ কম নেই। নগরকেন্দ্রগুলো একে একে হতন্ত্রী অবস্থায় পতিত হয়। হুন আক্রমণ প্রতিরোধ করাও আর সম্ভবপর হয়নি।