রাজনৈতিক ঐক্যের যুগ | The era of political unity (PART-4)

রাজনৈতিক ঐক্যের যুগ  | The era of political unity (PART-4)


1. প্রশ্ন : প্রবন্ধ রচনা কর :  মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের কারণ । The cause of the downfall of the Mauryan Empire.

ক. সূচনা : সাধারণত সাম্রাজ্যের ক্ষেত্রে যা হয়ে থাকে তা হল, প্রাচীনকালের অতি বৃহৎ সাম্রাজ্যগুলি এক সময়ে আপন ভাবেই ভেঙ্গে পড়ত। অতি বিশালায়তন মৌর্য সাম্রাজ্যের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি । প্রাচীনকালে অনুন্নত যাতায়াত ব্যবস্থা ও যোগাযোগ ব্যবস্থার দরুন সাম্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু থেকে সাম্রাজ্যের সর্বত্র নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা সম্ভবপর ছিল না। আবার এই নিয়ন্ত্রণের অভাবে দূরবর্তী এলাকাসমূহ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেত। এইভাবে প্রাচীন সাম্রাজ্য সবই ভেঙ্গে পড়েছিল। অবশ্য এই সাধারণ নিয়মের বাইরে আরও অনেক কারণ থাকে যা সাম্রাজ্যের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তোলে। মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের ক্ষেত্রেও এইসব কারণকে চিহ্নিত করা মোটেই কষ্টকর নয়।

খ. প্রাদেশিক শাসনের নানাবিধ সমস্যা : মৌর্য সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল ক্রমাগত আয়তন বৃদ্ধির মাধ্যমে । বিভিন্ন উপজাতিদের স্থানীয় কর্তৃত্বকে খর্ব করেই মৌর্যসম্রাটরা তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মৌর্যসম্রাটদের দুর্বলতার সুযোগে আবার তারা যে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার চেষ্টা করবে তা বলাই বাহুল্য। তাছাড়া যাতায়াতের অসুবিধার দরুন দূরবর্তী প্রদেশসমূহের ওপর কার্যকরী নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা মৌর্যসম্রাটদের পক্ষে সম্ভবপরও ছিল না মৌর্য আমলে প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের কুশাসনের কথাও সকলেরই জানা ছিল। প্রাদেশিক শাসক, যাঁরা অত্যাচারী ছিলেন, তাঁদের ‘দুষ্ট অমাত্য' বলে উল্লেখ করা হত। সময় ও সুযোগ বুঝে তাঁরা সর্বদাই কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবার চেষ্টা করতেন। যার ফলে মৌর্য সাম্রাজ্য এক সময় বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তির শিকার হয়েছিল।

গ. অশোকের উত্তরাধিকারীদের দুর্বলতা: অশোকের মৃত্যুর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মৌর্য সাম্রাজ্য ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়েছিল। সাম্রাজ্যের এই পরিণতির জন্য অশোকের পরবর্তী মৌর্যসম্রাটদের দুর্বলতাকেই দায়ী করা হয়ে থাকে। কারণ তাঁদের পক্ষে মৌর্য সাম্রাজ্যের মতো বিশাল সাম্রাজ্যকে পরিচালনা করা সম্ভবপর ছিল না। অশোকের মৃত্যুর পরবর্তী কালে একে একে কাশ্মীর, বিদর্ভ, গান্ধার প্রভৃতি সাম্রাজ্যের বাইরে চলে গিয়েছিল। সুতরাং একথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য বা অশোকের মতো শক্তিশালী রাজার আমলে যে সাম্রাজ্যের শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছিল তাদের পরবর্তী কালে অযোগ্য রাজাদের আমলে সেই সাম্রাজ্যেরই পতন ঘটেছিল।

ঘ. ব্রাহ্মণদের প্রতিক্রিয়াজনিত কারণ : মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী একটি তত্ত্ব তুলে ধরেছেন। তাঁর মতে, মৌর্যবংশীয় রাজারা ছিলেন শুদ্র বর্ণের মানুষ। অশোক অহিংসধর্ম পালন করতে গিয়ে জীবহত্যা প্রভৃতির ওপর যে নিষেধাজ্ঞা জারী করেছিলেন তাতে ব্রাহ্মণ্যধর্মাবলম্বীরা অসন্তুষ্ট হয়েছিল। কারণ কোন শূদ্র বর্ণের জারী করা নির্দেশ ব্রাহ্মণরা পূজা-পদ্ধতিতে যে প্রাণী উৎসর্গ করতে অভস্ত ছিল অশোকের নির্দেশে তা ব্যাহত হয়। যার অর্থ দাঁড়িয়েছিল এই যে সম্রাট অশোক ব্রাহ্মণদের ধর্ম পালনে বাধার সৃষ্টি করেছিলেন। অশোকের অনুসৃত নীতিতে ব্রাহ্মণরা অসন্তুষ্ট হওয়ার ফলে তাদের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল তার দরুন মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের কারণ খুঁজতে হবে অন্যত্র।

ঙ. মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনে অশোকের দায়িত্ব: কোন কোন ঐতিহাসিক এমন কথাও বলেছেন যে, অশোকের অনুসৃত অহিংস নীতি সাম্রাজ্যের সামরিক শক্তিকে দুর্বল করে দিয়েছিল। আর তার ফলে মৌর্য সাম্রাজ্যের পক্ষে অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ বা বহিঃশত্রুর আক্রমণ কোনকিছুই প্রতিরোধ বা প্রতিহত করা সম্ভপর হয়নি। কিন্তু একথা মনে রাখতে হবে যে, অশোক শাস্তি ও অহিংস নীতি অনুসরণ করলেও সামরিক বাহিনীর দুর্বলতাকে তিনি প্রশ্রয় দিয়েছিলেন এমন কোন তথ্য কারো জানা নেই । সামরিক বাহিনীর কুচকাওয়াজ প্রভৃতি নিয়মিতভাবে অনুষ্ঠিত হত বলে জানা যায় । তাছাড়া অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ দমনে বা বহিঃশত্রুর মোকাবিলায় অশোকের উত্তরাধিকারীরা যদি ব্যর্থ হয়ে থাকেন তাহলে তার দায় নিশ্চয়ই আশোকের নয় । প্রকৃতপক্ষে দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যবাহী মৌর্য সৈন্যবাহিনী এমন হতবীর্য মোটেই ছিল না যে আশোকের অহিংস নীতি তাদের একেবারে নিস্তেজ করে দেবে ।

চ. অর্থনৈতিক দুর্বলতা : প্রাচীন ভারতের ইতিহাস গবেষণায় সিদ্ধহস্ত ড. রোমিলা থাপার মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের জন্য তার অর্থনৈতিক দুর্বলতাকে বিশেষ প্রাধান্য দিয়েছেন । তার মতে মৌর্যসম্রাটরা যে বিশাল আমলাতান্ত্রিক সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন তাদের বেতন মেটাতে গিয়ে রাজকোষের একটা বড় অংশ ব্যয়িত হত। উপরত্ত ছিল বিশাল সৈন্যবাহিনীর ভরণ-পোষণ তাছাড়া নতুন নতুন এলাকায় বসতি গড়ে তুলতে গিয়েও প্রচুর অর্থ ব্যয়িত হত। এইভাবে নানা খাতে প্রচুর অর্থ ব্যয়িত হওয়ায় রাজকোষে অর্থের টানাটানি পড়ে গিয়েছিল। কারণ সরকারী আয় এবং ব্যয়ের মধ্যে আর সমতা বজায় রাখা সম্ভবপর হচ্ছিল না । সবচেয়ে বড় কথা হল, মৌর্য সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটলেও তার অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা সম্রাজ্যের সর্বত্র সমানভাবে লক্ষ্য করা যায়নি । কৃষি-উদবৃত্ত এলাকা থেকে যে পরিমাণ রাজস্ব আদায় হত গোটা সাম্রাজ্যের ব্যয়-সংকুলানের পক্ষে তা মোটেই যথেষ্ট ছিল না এইভাবে মৌর্য সাম্রাজ্য যে আর্থিক অভাব অনটনের মধ্যে পড়েছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় মুদ্রার ধাতব-মূল্য হ্রাসপ্রাপ্তি থেকেও।

ছ. মৌর্য সাম্রাজ্যের চূড়ান্ত পতন: নানা কারণের সমষ্টিগত ফল হিসাবে মৌর্য সাম্রাজ্য যখন পতনের দিকে ধাবিত তখন তার ওপর চূড়ান্ত আঘাত হেনেছিল সুঙ্গ বংশীয় জনৈক পুষ্যমিত্র সুঙ্গ। তিনি শেষ মৌর্য শাসক বৃহদ্রথকে পরাজিত এবং হত্যা করে মগধের সিংহাসন কেড়ে নিয়েছিলেন কথিত আছে  পুষ্যমিত্র সুঙ্গ ছিলেন বৃহদ্রথের আমলে মৌর্য সেনাপতি। ১৮০ খ্রীস্টপূর্বাব্দে পুষ্যমিত্র সুঙ্গ মগধের সিংহাসন দখল করে নেওয়ায় মগধে মৌর্য বংশের ইতি ঘটেছিল ।


 2. প্রশ্ন : ভারতীয় সভ্যতা-সংস্কৃতিতে কুষাণদের অবদান কি ? অথবা  কুষাণযুগে ভারতীয় সংস্কৃতির বিকাশ সম্পর্কে প্রবন্ধ রচনা কর ।  What is the contribution of Kushans to Indian civilization and culture? Or write an essay on the development of Indian culture in the Kushan period.

ক. সুচনা : কুষাণরা ভারতীয় নয় অর্থাৎ ভারতের বাইরে থেকে এসে তারা এদেশে : বিশাল এক সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল এই যে কুষাণদের প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্য তা রাজনৈতিক দিক দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল । আবার অর্থনৈতিক দিক দিয়ে কুষাণাদের আমলে ভারতবর্ষের যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছিল। কিন্তু সভ্যতা-সংস্কৃতির বিকাশে কুষাণদের অবদান সবচেয়ে বেশি ।

খ. সাহিত্য, নাটক প্রভৃতি : কুষাণদের আমলে যে সাংস্কৃতিক উন্নতি তার প্রধান নায়ক ছিলেন কণিষ্ক । সমসাময়িক অনেক বৌদ্ধ পণ্ডিতের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল । অশ্বঘোষ ছিলেন একাধারে কবি, দার্শনিক, সঙ্গীতজ্ঞ এবং নাট্যকার । তাঁর বিখ্যাত রচনা ‘বুদ্ধচরিত’ সংস্কৃত ভাষায় রচিত । তাছাড়া ‘সৌন্দরনন্দ’ নামে অপর একখানি কাব্যগ্রন্থ-ও তিনি রচনা করেছিলেন । সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে অশ্বঘোষের পরেই নাগার্জুনের স্থান । তিনি এক সময়ে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করলেও বেদ এবং অপরাপর ব্রাহ্মণ্য ধর্মগ্রন্থে তাঁর অসাধারণ পাণ্ডিত্য ছিল। নাগার্জুন যে দর্শনশাস্ত্রে নতুন তত্ত্বের আবিষ্কার করেছিলেন তা ‘মাধ্যমিক’ নামে অভিহিত।

গ. জ্ঞান-বিজ্ঞান : কণিষ্কের অপর দুই সহযোগী চরক এবং সুশ্রুত বিজ্ঞান এবং প্রয়োগবিদ্যার বিভিন্ন শাখায় কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন । চরককে ভারতীয় আয়ুর্বেদশাস্ত্রের পথপ্রদর্শক বলা যেতে পারে। আর সুশ্রুত শল্যবিদ হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন । এইসব মনীষীরা কুষাণযুগের গৌরব বর্ধন করেছিলেন । সেযুগের ধাতুশিল্পীরাও কৃতিত্ব প্রদর্শন করেছিলেন । পরবর্তী কালে ভারতীয় ধাতুশিল্পীরা এবিষয়ে আরও উন্নতি করেছিলেন ।

ঘ. শিল্পকলা : শিল্পকলার ক্ষেত্রে কুষাণযুগ ছিল এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় । বিদেশী কুষাণরা ভারতীয় শিল্প-সাহিত্যের প্রতি যে কতটা আগ্রহ পোষণ করতেন তার ভুরি ভুরি প্রমাণ আছে ৷ কুষাণদের সঙ্গে যেসব কারিগর এবং শিল্পী এদেশে উপস্থিত হয়েছিলেন তাঁদের সংস্পর্শে এসে ভারতীয় শিল্পীরা এক অনবদ্য শিল্পরীতির বিকাশ ঘটিয়েছিলেন ‘গান্ধার শিল্প’ নামে পরিচিত এই শিল্প ভারতীয় এবং গ্রীক শিল্পের মিশ্রণে সৃষ্টি হয়েছিল। গান্ধার শিল্পরীতি অনুসারে গৌতম বুদ্ধের অসংখ্য মূর্তি তৈরী হয়েছিল। কেবল তা-ই নয়, কুষাণ আমলে সম্পূর্ণ ভারতীয় রীতিতে-ও কয়েকটি ঘরানার সৃষ্টি হয়েছিল। যথা : অমরাবতী, মথুরা, নাগার্জুনকোণ্ডা প্রভৃতি ।

ঙ. বহির্ভারতে ভারতীয় সংস্কৃতি : ধর্ম সংস্কৃতির-ই অঙ্গ । কুষাণ যুগে ভারত এবং পশ্চিম এশিয়ার মধ্যে যে ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু হয়েছিল তা সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের পথ প্রশস্ত করেছিল ব্যবসায়ীদের দেখাদেখি বৌদ্ধ প্রচারকরা বিভিন্ন দেশে উপস্থিত হয়েছিলেন গৌতম বুদ্ধের বাণী উপহার দিতে । এই সূত্রেই পশ্চিম এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, চীন প্রভৃতি দেশে বৌদ্ধধর্ম বিস্তারলাভ করেছিল ধর্মের সঙ্গে সঙ্গে আবার ভারতীয় সভ্যতা-সংস্কৃতি-ও গিয়ে পৌঁছেছিল ঐসব দেশে ।  যার ফলে ভারতের সাংস্কৃতিক বিজয়ের পথ উন্মুক্ত হয়েছিল ।

এইভাবে বলা যায় যে, কুষাণ আমলে ভারতীয় সভ্যতা-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যে উন্নতি হয়েছিল সেই পথ ধরেই পরবর্তী সময়ে ভারতীয় মনীষীরা ক্রমাগত উন্নতির পথে আরও এগিয়ে চলেছিলেন ।

 3. প্রশ্ন : অশোককে একজন মহান সম্রাট বলা হয় কেন ? অথবা  ভারত তথা বিশ্বের ইতিহাসে অশোকের স্থান নির্ণয় কর । অথবা  ভারতের ইতিহাসে অশোক স্মরণীয় কেন ? 
Why is Ashoka called a great emperor? Or find Ashoka's place in the history of India and the world. Or why Ashoka is memorable in the history of India?

ক. সূচনা : মানুষ এবং সুশাসক হিসাবে মৌর্যসম্রাট অশোক সর্বকালের রাজাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ স্থান অধিকার করে রয়েছেন । অশোকের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করবার জন্য অনেক ঐতিহাসিক তাঁকে বিভিন্ন সময়ে দেশ-বিদেশের হিন্দু, মুসলিম, খ্রীস্টান এবং অপরাপর ধর্মের রাজাদের সঙ্গে তুলনা করে থাকেন। কিন্তু সকলেই একবাক্যে অশোকের শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়েছেন ।

খ. অশোকের প্রথম জীবন : সম্রাট হিসাবেই অশোক তাঁর জীবন শুরু করেছিলেন । সম্রাট সুলভ আমোদ-প্রমোদ, শিকার, যুদ্ধ-বিগ্রহ স্বভাবতই তাঁর খুবই প্রিয় ছিল । সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব থেকে তিনি কলিঙ্গ আক্রমণ-ও করেছিলেন । কিন্তু সেই রাজ্য জয় করতে গিয়ে তিনি যে আঘাত পেয়েছিলেন তা তার জীবনে পরিবর্তন এনে দিয়েছিল ।

গ. কলিঙ্গ-যুদ্ধ এবং অশোকের পরিবর্তন : কলিঙ্গ-যুদ্ধ জয় করতে গিয়ে অশোকের যেন মৃত্যুর সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল । হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু, এবং তার কয়েক গুণ বেশি মানুষের দুর্দশা অশোকের মনে অনুশোচনার সৃষ্টি করেছিল । তিনি যুদ্ধ-বিগ্রহ তো বটেই, এমন কি হিংসার অসারতা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন । তিনি অতঃপর অহিংস বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করে অহিংসার একজন পূজারীতে পরিণত হন।

ঘ. অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে পরিবর্তন : কলিঙ্গ-যুদ্ধ অশোকের অনুসৃত নীতিতে এক বিরাট পরিবর্তন ঘটিয়েছিল। অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় শাসন সংস্কারে এবং অশোক কর্তৃক গৃহীত নতুন জনসেবামূলক কার্যাদিতে । প্রশাসনিক ক্ষেত্রে ধর্মমহামাত্র, যুত প্রভৃতি কর্মচারীরা প্রজাবর্গের মঙ্গলার্থে সর্বদা নিযুক্ত থাকতেন । নতুন নতুন ধর্মসমাজ, ধর্মমঙ্গল প্রভৃতির আয়োজন করা হত । তাছাড়া জীবমাত্রেরই যাতে সুবিধা হয় সেজন্য রাস্তার ধারে কূপখনন, বৃক্ষরোপণ প্রভৃতির ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

ঙ. পররাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে পরিবর্তন : অশোক জাতীয় জীবনের প্রতিটি স্তরে যেমন সাম্য, মৈত্রী এবং অহিংসার বাণীকে বাস্তবায়িত করবার চেষ্টা করেছেন, তেমনিভাবে ঐসব আদর্শ উপস্থিত করেছিলেন নিকটবর্তী রাজ্যের রাজাদের কাছে । তিনি প্রথমেই প্রতিবেশী রাজাদের এই বলে আশ্বস্ত করেছিলেন যে, তিনি আর দিগ্বিজয় নীতিতে বিশ্বাস করেন না । তিনি প্রতিবেশীদের অভয় দিয়েছিলেন যে মৌর্য সাম্রাজ্যকে আর ভীতির চোখে দেখবার কোনও কারণ নেই । অশোক কেবল তাদের সুখের কারণ  হবেন ।

চ. রাজকর্তব্য সম্পর্কে অশোকের ধারণা :  অশোক রাজকর্তব্যের যে আদর্শ তুলে ধরেছিলেন : তা রাষ্ট্রনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রে এক বিপ্লব এনেছিল । তিনি মানুষমাত্রেই নিজের সন্তান বলে ঘোষণা করেছিলেন। এই ধরনের সর্বজনীন আদর্শ আর কোনও নৃপতির কল্পনাতেও আসেনি। 

ছ. অশোক এবং আকবর : সম্রাট অশোকের সঙ্গে মুঘলসম্রাট আকবরের তুলনা খুবই সঙ্গত এই কারণে যে উভয়েই প্রজাদের মঙ্গলসাধনের জন্য জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। তাছাড়া উভয়েই নিজ নিজ কাজের দ্বারা ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন । তথাপি অস্বীকার করবার উপায় নেই যে, অশোকের সঙ্গে আকবরের মৌলিক কিছু পার্থক্য রয়েছে । অশোকের জীবনে পরিবর্তন এনেছিল একটিমাত্র যুদ্ধ। কিন্তু আকবর একজন সাম্রাজ্যবাদী বিজেতা হিসাবে একের পর এক যুদ্ধ করে চলেছিলেন । আকবর অস্ত্রের দ্বারা জয় করেছিলেন, আর অশোক জয় করেছিলেন মানুষের মনকে ভালবাসা ও মৈত্রীর দ্বারা।

জ. অশোকের উত্তীর্ণ শিলালিপি : অশোকের মহত্ত্বের অপর একটি দিক হল তাঁর উৎকীর্ণ শিলালিপি, প্রস্তরলিপি প্রভৃতি, যা আজকের দিনেও সকলের বিস্ময় সৃষ্টি করে থাকে । অশোক অনেক প্রশাসনিক নির্দেশ যেমন শিলালিপিতে উৎকীর্ণ করিয়েছিলেন তেমনিভাবে শান্তি, অহিংসা ও মৈত্রীর বাণী, গৌতমবুদ্ধের প্রচারিত ধর্মের মূল সত্য প্রভৃতি শিলালিপি, স্তম্ভলিপি বা পর্বতগাত্রে উৎকীর্ণ করিয়েছেন। যাতে মানুষমাত্রেই এসবের দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে। বিশ্বের আর কোনও নৃপতি ই সম্ভবত অশোকের মতো মহান উদ্দেশ্য নিয়ে এত বিপুল সংখ্যক লিপি উৎকীর্ণ করাননি ।

উপরিউক্ত বক্তব্য বিচার করলে বিখ্যাত পণ্ডিত এইচ. জি. ওয়েলস’এর সঙ্গে সুর মিলিয়ে বলা যায় যে, আকাশে নক্ষত্ররাজির মতো ইতিহাসের পৃষ্ঠায় যে শত-সহস্র সম্রাট ভিড় করে আছেন তাঁদের মধ্যে একমাত্র অশোকের নাম-ই উজ্জ্বল তারার মতো দেদীপ্যমান ।

4. প্রশ্ন : গুপ্তযুগের সভ্যতা-সংস্কৃতির উপর একটি প্রবন্ধ রচনা কর।  Write an essay on Gupta culture and civilization.

 ক. সুচনা : ভারতীয় সভ্যতা-সংস্কৃতির ইতিহাসে গুপ্তযুগ এক স্মরণীয় অধ্যায়। কেবল সাম্রাজ্য গঠনের দিক থেকেই নয়, গুপ্তরাজদের প্রভাব ও প্রতিপত্তিতে আশেপাশের নৃপতিরা তাদের আনুগত্য স্বীকার করে নিয়েছিলেন। গুপ্তরাজদের আমলের উন্নত প্রশাসনিক ব্যবস্থা দেশের সর্বত্র শাস্তি ও শৃঙ্খলাকে সুনিশ্চিত করেছিল। সুতরাং বলা যেতে পারে যে, সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশের সহায়ক পরিবেশ বজায় ছিল বলেই গুপ্তযুগ গৌরবময় অধ্যায় হিসাবে ভারতের ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে আছে । এই সূত্রে কেউ । কেউ ইংলণ্ডের এলিজাবেথ এর সময়কার সাংস্কৃতিক উন্নতির সঙ্গে গুপ্তযুগকে তুলনা করেছেন। আবার অনেকে পেরিক্লিস’এর রাজত্বকালে এথেন্স’এর সাংস্কৃতিক সাফল্যের সঙ্গেও গুপ্তযুগকে তুলনা করছেন। এই সাধারণ বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে গুপ্ত আমলের সভ্যতা-সংস্কৃতির অগ্রগতির কাহিনী আলোচনা করা যেতে পারে।

খ. গুপ্ত সম্রাটদের পৃষ্ঠপোষকতা : গুপ্তসম্রাটরা নিজেরা ছিলেন বিদ্যাশীল মানুষ, যে কারণে বিদ্যাচর্চা ও জ্ঞানী-গুণী মানুষের কদর করতে তাঁরা অভ্যস্ত ছিলেন। উদাহরণ হিসাবে প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় সমুদ্রগুপ্তের কথা। সমুদ্রগুপ্ত স্বয়ং কাব্য রচনায় পারদর্শী ছিলেন। তাঁর কাব্য-প্রতিভার স্বীকৃতি হিসাবেই সমুদ্রগুপ্ত ‘কবিরাজ’ উপাধি প্রাপ্ত হয়েছিলেন। সঙ্গীতশাস্ত্রেও সমুদ্রগুপ্তের যে বিশেষ অনুরাগ ছিল তা সর্বজনস্বীকৃত। সমুদ্রগুপ্তের মুদ্রায় দেখা যায় যে তিনি বীণাবাদনরত। এই মুদ্রা তার সঙ্গীতানুরাগের ইঙ্গিত বহন করে। সমুদ্রগুপ্তের উত্তরাধিকারী দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিদ্বান ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। তার রাজসভায় যেসব প্রতিভাবান মানুষ আসন গ্রহণ করতেন তাঁদের অনেকেই বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেছেন, যেমন কালিদাস । এইভাবে গুপ্তসম্রাটদের পৃষ্ঠপোষকতায় গুপ্তযুগে সভ্যতা-সংস্কৃতির বিকাশ সম্ভবপর হয়েছিল ।

গ. অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা : দেশ তথা দেশবাসীর আর্থিক স্বচ্ছলতা সংস্কৃতি বিকাশের সহায়ক। পক্ষান্তরে অভাব-অনটন ও আর্থিক দৈন্যদশা সাংস্কৃতিক অগ্রগতির পরিপন্থী । গুপ্তযুগে ব্যবসা-বাণিজ্যের অগ্রগতির ফলে আর্থিক উন্নতির কথা বিভিন্ন সূত্রে জানা গিয়েছে । ভারতীয় উপকূলে অবস্থিত বন্দরগুলি  থেকে ব্যবসায়ীরা দেশ-বিদেশে যাতায়াত করতেন পণ্য-সামগ্রীর আদান-প্রদানের উদ্দেশ্যে। তাছাড়া বৈদেশিক বাণিজ্যেও সেই সময়ে ভারতবর্ষ জায়গা করে নিয়েছিল। রোম সাম্রাজ্যের সঙ্গে বাণিজ্য গুপ্তযুগের অর্থনৈতিক উন্নতির অন্যতম কারণ । গুপ্ত শাসনকালের এই অর্থনৈতিক উন্নতি সভ্যতা-সংস্কৃতির বিকাশের সহায়ক হয়েছিল । অভাব-অনটন থেকে মুক্ত মানুষ মানসিক উৎকর্ষ সাধনে ব্যাপৃত থাকতে পেরেছিল। এইভাবে সাংস্কৃতিক জীবনে উন্নতির পক্ষে সহায়ক পরিবেশ গুপ্তযুগে পূর্ণমাত্রায় বিরাজমান ছিল।

ঘ. সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের উন্নতি : গুপ্ত আমলে বিখ্যাত সব কবি, সাহিত্যিক আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাঁদের রচনার দ্বারা সমৃদ্ধ হয়েছিল সেই যুগ। আর সমুদ্রগুপ্ত ও দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত উভয়ে তো কাব্য রসিক ছিলেন-ই । সমসাময়িক কবি ও সাহিত্যিকদের মধ্যে সমুদ্রগুপ্তের সভাকবি হরিষেণ এবং সভাসদ বীরসেন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য । হরিষেণ বিরচিত 'এলাহাবাদ প্রশস্তি’ কেবল সমুদ্রগুপ্তের ইতিহাস রচনার উপাদান হিসাবেই নয়, সাহিত্য নিদর্শন হিসাবেও মূল্যবান ।

সমসাময়িক ভারতের শ্রেষ্ঠ কবি ও নাট্যকার ছিলেন কালিদাস । তিনি সম্ভবত দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের নবরত্ন-সভার অন্যতম ছিলেন। তাঁর রচিত ‘অভিজ্ঞানশকুন্তলম’, ‘রঘুবংশ’, ‘মেঘদূত’ প্রভৃতি আজকের দিনেও বিশ্বসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ হিসাবে বিবেচিত হয়ে থাকে। গুপ্তযুগের অন্যান্য সাহিত্যসেবীদের মধ্যে ছিলেন ‘মৃচ্ছকটিকম’ প্রণেতা শূদ্রক ; ‘মুদ্রারাক্ষস’ প্রণেতা বিশাখদত্ত প্রভৃতি । বৌদ্ধ দর্শনে সুপণ্ডিত অসঙ্গ ও বসুবন্ধু গুপ্তযুগেই আবির্ভূত হয়েছিলেন ।

ঙ. জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা : সাহিত্য ব্যতীত গণিত-শাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা প্রভৃতি ক্ষেত্রেও গুপ্তযুগ উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে গিয়েছে । আর্যভট্ট, বরাহমিহির প্রমুখ মনীষীর অবদানে গুপ্তযুগে পুষ্ট হয়েছিল। আর্যভট্ট ছিলেন পাটলিপুত্রের বাসিন্দা তার রচিত গ্রন্থের সঠিক সংখ্যা নির্ণয় করা সম্ভব না হলেও একথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে, তাঁর 'আর্যভট্টীয়’ গ্রন্থখানি গণিতশাস্ত্র এবং জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত নানা তথ্যে পরিপূর্ণ । বরাহমিহির মূলত ছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী । তিনি ‘রোমক সিদ্ধান্ত’ রচনা করে খ্যাতিমান হন । গুপ্তযুগে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিবিদ্যায় যে স্পরিগররা বিশেষ উন্নতি করেছিল তারও প্রমাণ আছে। ব্রোঞ্জ এবং লোহা, এই দুটি ধাতু হিসাবে বেশি ব্যবহৃত হত, এবং কারিগররা এইসব বিদ্যায় পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন। দিল্লীর অন্তর্গত মেহেরৌলির লৌহস্তম্ভ সেসময়কার ধাতুশিল্পীদের উন্নত মানের পরিচয় বহন করে।

চ. সাংস্কৃতিক অগ্রগতি : শিল্পকলার ক্ষেত্রেও যে গুপ্তযুগ যথেষ্ট উন্নতির পরিচয় দিয়েছিল সমসাময়িক নিদর্শনগুলি থেকে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। শিল্পকলার তিনটি শাখা—স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্রকলাতে গুপ্তযুগে শিল্পীরা পারদর্শিতা দেখিয়েছিলেন। গুপ্ত স্থাপত্য এবং ভাস্কর্যের অনবদ্য সৃষ্টি হল, ঝান্সি জেলায় দেওগড়ের মন্দির, কানপুরে ভিটারগাঁও প্রভৃতি । চিত্রকলার ক্ষেত্রে অজন্তা এবং ইলোরার গুহাচিত্রসমূহ আজও দর্শকদের বিস্ময়ের বস্তু ।

এইভাবে গুপ্তযুগ সাম্রাজ্য গঠন থেকে শুরু করে শিল্পকলা—সব ক্ষেত্রেই চরম উন্নতির পরিচয় দিয়েছিল। যে কারণে এই যুগকে গ্রীক ইতিহাসের ‘পেরিক্লিসের যুগ’ অথবা ইংলণ্ডের ইতিহাসের ‘এলিজাবেথের যুগের’ সঙ্গে তুলনা করা হয়ে থাকে আবার সাম্রাজ্যের সর্বাঙ্গীণ উন্নতির জন্য গুপ্তযুগকে ভারত-ইতিহাসের সুবর্ণযুগ বলেও অনেকে অভিহিত করে থাকেন। তবে কোনও কোনও ঐতিহাসিক এবিষয়ে আপত্তি জানিয়েছেন।


Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.