রাজনৈতিক ঐক্যের যুগ | The era of political unity (PART-2)

রাজনৈতিক ঐক্যের যুগ | The era of political unity (PART-2)

 

১। প্রশ্ন : মৌর্যদের শাসনব্যবস্থা কিরূপ ছিল সংক্ষেপে লেখ । Briefly write about the rule of Mauryas.

ক. সূচনা : মৌর্যদের শাসনব্যবস্থা কিরূপ ছিল তা জানতে গেলে নির্ভর করতে হয় নানা উত্তর : ধরনের সূত্রের ওপর । যেমন : কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, মেগাস্থিনিসের বিবরণ, অশোকের লেখমালা প্রভৃতি । মৌর্য শাসনব্যবস্থা নির্মাণ করেছিলেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য। তারপরে এতে নতুন কিছু বৈশিষ্ট্য যুক্ত করেছিলেন অশোক ।

খ. সম্রাট : মৌর্যসম্রাট একজন স্বৈরাচারী রাজা ছিলেন, যাঁর ক্ষমতা ছিল অপরিসীম। তার আনন্দ এবং দুঃখের ওপর-ই প্রজাদের সুখ-দুঃখ নির্ভর করত । মেগাস্থিনিসের বক্তব্য অনুসারে রাজাকে সাহায্য করবার জন্য একটি মন্ত্রিপরিষদ ছিল ঠিকই । তবে এই পরিষদের মতামত রাজা গ্রহণ করবেনই তেমন কোনও কথা নেই। সাম্রাজ্যের সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য তাকে নানা ভাগে ভাগ করা হয়েছিল।

গ. কেন্দ্রীয় প্রাদেশিক ও নগর শাসন : রাজা বা মৌর্যসম্রাট এবং মন্ত্রিপরিষদ নিয়ে যেমন কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা প্রচলিত ছিল, তেমনি প্রদেশগুলির দায়িত্ব ছিল এক একজন শাসনকর্তার ওপর । গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশগুলোর দায়িত্ব দেওয়া হত রাজপরিবারের সদস্যদের ওপর । তাছাড়া অপরাপর প্রদেশগুলোর শাসনকর্তা হিসাবে এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তিকে নিয়োগ করা হত । প্রাদেশিক শাসনের মত-ই গুরুত্বপূর্ণ ছিল নগর শাসন । প্রধান প্রধান শহরের মধ্যে ছিল পাটলিপুত্র, কৌশাম্বী, তক্ষশিলা এবং উজ্জয়িনী । এগুলোর মধ্যে আবার পাটলিপুত্র রাজধানী নগরীর শাসনব্যবস্থা ছিল সম্পূর্ণ আলাদা ধরনের । ছয়টি বিভিন্ন কমিটি পাটলিপুত্রের শাসন পরিচালনা করত । প্রতিটি কমিটির সদস্য সংখ্যা ছিল পাঁচ ।

ঘ. সামরিক শাসন : বেসামরিক প্রশাসনের মতো সামরিক প্রশাসনও সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত হত চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের বিশাল সামরিক বাহিনীতে যেমন ছিল পদাতিক, তেমনি ছিল হস্তীবাহিনী এবং ঘোড়সওয়ার। মেগাস্থিনিসের বিবরণী থেকে জানা যায় যে, সামরিক বাহিনী পরিচালিত হত ত্রিশজন সদস্যবিশিষ্ট একটি সভার দ্বারা । এই ত্রিশজন সদস্য আবার ছয়টি ভাগে বিভক্ত হয়ে এক একটি বিভাগ পরিচালনা করতেন।

ঙ। অর্থনীতি-পরিচালনা : চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য আবার রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকটাও নজর দিয়েছিলেন। বিশাল সৈন্যবাহিনী এবং সুবিস্তৃত বেসামরিক লোকজনকে মাস-মাহিনা দেবার ব্যবস্থা ছিল বলে মৌর্যসম্রাটকে রাজকোষ পরিপূর্ণ রাখতে হত যে কারণে তিনি কর আদায় করবার কোনও সুযোগই ছাড়েননি । কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র থেকে জানা যায় যে, মৌর্য সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক কার্যকলাপ সরকার নিয়ন্ত্রণ করত । ভূমিরাজস্ব হিসাবে কর আদায় ব্যতীত শহরাঞ্চলে যেসব সামগ্রী বিক্রীর জন্য আসত তার ওপর শুল্ক আদায় করা হত ।

চ। অশোকের সংযোজন : এইভাবে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য যে শাসনব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন অশোক তাকে আরও মানবতাবাদী করে তুলেছিলেন । অশোক রাজকর্তব্যের যে নতুন আদর্শ তুলে ধরেছিলেন তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তিনি সরকারী কর্মচারীদের নির্দেশ দিয়েছিলেন যাতে তারা প্রজাদের মঙ্গল সাধনের জন্য সর্বদা সচেষ্ট থাকেন অশোক ধর্মমহামাত্র এবং রাজুক নামে দুই ধরনের নতুন কর্মচারী নিয়োগ করেছিলেন । ধর্মমহামাত্রদের কাজ ছিল প্রজাদের মধ্যে ধর্ম প্রচার করা। আর রাজুকদের ওপর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল সাম্রাজ্যের কোথাও অবিচার কিছু ঘটছে কিনা তার ওপর নজর রাখবার । 

ছ. জনহিতকর কার্যকলাপ : মৌর্য শাসনব্যবস্থা সামগ্রিকভাবে জনসাধারণের কল্যাণার্থে যে পরিচালিত হত তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। অশোকের আমলে জীবমাত্রের-ই স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য যে পরিসেবা-কেন্দ্র গঠন করা হয়েছিল তাছাড়া ও আকাল বা অজন্মার সময় মানুষ যাতে অসুবিধায় না পড়ে সেজন্য শস্যভাণ্ডারে খাদ্যশস্য মজুত রাখা হত । মহাজনরা যাতে চড়া হারে সুদ আদায় করে অযথা হয়রান না করতে পারে তার জন্যও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা সরকার গ্রহণ করেছিল । জল-নিষ্কাষণ ব্যবস্থার উন্নতির মাধ্যমে জনসাধারণের স্বাস্থ্যরক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা সরকার থেকেই করা হত ।

এইভাবে মৌর্য শাসনব্যবস্থা আধুনিক যে কোন দেশের শাসনব্যবস্থার সঙ্গেই তুলনীয় হয়ে আছে। 

২। প্রশ্ন : কুষাণরাজ কণিষ্ক সম্বন্ধে যা জান লেখ ।  অথবা  ভারত-ইতিহাসে কণিষ্কের স্থান নির্ণয় কর ।  Write what you know about Kushanraj Kanishka. Or determine Kanishka's place in Indian history.

উত্তর : ক. সূচনা : কুষাণরা ভারতীয় নয়, বহিরাগত ছিল । অর্থাৎ বিদেশ থেকে নানা কারণে তারা ভারতে প্রবেশ করেছিল । এই কুষাণদের রাজ্যগঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল কণিষ্কের অনেক আগে থেকে । আর কণিষ্কের আমলে সেই কুষাণরাজ্য সাম্রাজ্যের রূপ গ্রহণ করেছিল । কুষাণরাজ কণিষ্ক শাসক এবং বিজেতা হিসাবে অন্যতম শ্রেষ্ঠ নৃপতি ছিলেন । তাছাড়া তাঁর আমল সাংস্কৃতিক উন্নতির জন্যও প্রসিদ্ধ হয়ে আছে ।

খ. বিজেতা কণিষ্ক : বিজেতা হিসাবে কণিষ্ক তার পিতৃপুরুষের শুরু করা কাজ সম্পূর্ণ করেছিলেন। অর্থাৎ রাজ্যবিস্তারের যে কাজ তারা শুরু করেছিলেন কণিষ্ক তা সাফল্যমণ্ডিত করে তোলেন । কণিষ্ক কাশ্মীর এবং মগধ সমেত সমগ্র উত্তর-ভারত জয় করেছিলেন। চীনসম্রাটের সঙ্গে কণিষ্কের যে সংঘর্ষ হয় তাতে কণিষ্ক জয়লাভ করেছিলেন। ; এবং কাশগড়, খোটান প্রভৃতি এলাকা তাঁর কাছ থেকে কেড়ে ও নিয়েছিলেন । বর্তমান উজবেকিস্তানও কণিষ্ক তাঁর সাম্রাজ্যভুক্ত করেছিলেন । পুরুষপুর, বর্তমান পেশোয়ার কণিষ্কের রাজধানী ছিল ।

গ. ধর্মপ্রচারক কণিষ্ক : কণিষ্ক কেবল রাজ্যজয়ী বীর হিসাবেই ইতিহাসে প্রসিদ্ধ নন। ধর্মপ্রচারক এবং শিক্ষা-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক হিসাবেও তিনি প্রসিদ্ধিলাভ করেছেন। বৌদ্ধধর্মের একজন প্রচারক হিসাবে তাকে অনেকে অশোকের সঙ্গে তুলনা করেছেন এই তুলনা অতিরঞ্জিত হলেও একথা অনস্বীকার্য যে, কণিষ্ক বৌদ্ধধর্ম প্রচারে যথেষ্ট সাফল্যলাভ করেছিলেন । কেবল তা-ই নয়, তাঁর-ই উৎসাহে বৌদ্ধধর্মে মতবিরোধ নিষ্পত্তির জন্য কাশ্মীরের কুণ্ডলবনে চতুর্থ বৌদ্ধ সংগীতি আহূত হয় ।

ঘ. সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক কণিষ্ক : কণিষ্কের রাজত্বকালে ভাস্কর্য এবং স্থাপত্যশিল্পের চরম উন্নতি ঘটেছিল। তাঁর উৎসাহে যমুনা নদীর তীরে বহু স্তূপ নির্মিত হয়েছিল । তাছাড়া মথুরা এক বিশাল নগরীতে পরিণত হয়েছিল । আবার কণিষ্কের রাজত্বকালেই গান্ধার শিল্পরীতির বিকাশ ঘটেছিল । কণিষ্কের আমলে কেবল স্থাপত্য-ভাস্কর্য শিল্পকলাই নয়, সংস্কৃতির অপরাপর শাখাও পল্লবিত হয়েছিল । কণিস্কের রাজসভায় যেসব জ্ঞানী-গুণী মানুষ সমবেত হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে আছেন অশ্বঘোষ, চরক, নাগার্জুন প্রমুখ ।

কণিষ্ক বিদ্যা ও বিদ্বান ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন বলেই তাঁর আমলে বিভিন্ন শাস্ত্রে একাধিক পণ্ডিত ব্যক্তি তাঁদের লেখনীর দ্বারা সেযুগকে স্মরণীয় করে তুলেছেন । ‘বুদ্ধ-চরিত’ রচয়িতা অশ্বঘোষ বুদ্ধের জীবনের নানা ঘটনা ঐ গ্রন্থে সংকলিত করেছিলেন। সাহিত্যে যেমন ছিলেন অশ্বঘোষ তেমনি দার্শনিক হিসাবে সেযুগের শ্রেষ্ঠ ছিলেন নাগার্জুন। হিন্দুধর্মাবলম্বী নাগার্জুন বৌদ্ধধর্ম গ্রহণের পরে বৌদ্ধ দর্শন নিয়েই চর্চা করেছিলেন বসুমিত্র ছিলেন অপর এক বৌদ্ধ দার্শনিক বসুমিত্র ছিলেন ‘বিভাষা সূত্র' গ্রন্থের প্রণেতা ।

গান্ধার শিল্পীরা বৌদ্ধ সম্পর্কিত বিষয় নিয়েই শিল্প-চর্চা করতেন । তাদের শিল্প-চর্চা প্রকাশ পেয়েছে বহু বৌদ্ধ মঠ বা বিহার, স্তূপ এবং ভাস্কর্য নিদর্শনে। গান্ধার শিল্পীরা গ্রীক শিল্পরীতির দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন যে কারণে দেখা যায় যে, বুদ্ধ-মূর্তি তারা নির্মাণ করেছেন গ্রীক-দেবতা অ্যাপোলোর অনুকরণে । গান্ধার শিল্পরীতি বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে সঙ্গে সুদূর-প্রাচ্যে গিয়ে পৌঁছেছিল কণিষ্কের  পৃষ্ঠপোষকতায় যেমন গড়ে উঠেছিল বিদেশী প্রভাবিত গান্ধার শিল্প তেমনিভাবে আবার সৃষ্টি হয়েছিল সম্পূর্ণ ভারতীয় শিল্পরীতিকে ভিত্তি করে মথুরা এবং অমরাবতী শিল্পরীতি । কণিষ্ক সারনাথ, মথুরা, অমরাবতী, গান্ধার প্রভৃতি নগরীতে বৃহৎ আকারের অথচ সুন্দর সুন্দর দালান, প্রাসাদ প্রভৃতি নির্মাণ করে ঐগুলোকে সাজিয়েছিলেন ।

এইভাবে সবদিক বিবেচনা করলে বলতে হয় যে, কণিষ্কের রাজত্বকাল ভারত-ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায় । ভারতে রাজনৈতিক অনৈক্যের যুগে কণিষ্কের নেতৃত্বেই পুনরায় সাম্রাজ্যিক ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

৩. প্রশ্ন: সমুদ্রগুপ্তের কৃতিত্ব আলোচনা কর ।  Discuss the achievements of Samudragupta.

উত্তর : ক. সূচনা : প্রথম চন্দ্রগুপ্তের পুত্র সমুদ্রগুপ্ত ছিলেন গুপ্ত বংশের শ্রেষ্ঠ সম্রাট। তাঁর চরিত্রে নানা গুণের সমাবেশ লক্ষ্য করা যায় । তিনি একজন বিজেতা হিসাবে পরিচিত হলেও শাসক এবং সংস্কৃতিবান পুরুষ হিসাবে সমধিক প্রসিদ্ধ সবচেয়ে বড় কথা হল এই যে, সমুদ্রগুপ্ত তাঁর রাজনৈতিক কার্যকলাপে যে বুদ্ধিমত্তা এবং বাস্তবজ্ঞানের পরিচয় দিয়েছিলেন তেমন আর কেউ পেরেছিলেন কিনা সন্দেহ।

খ. বিজেতা সমুদ্রগুপ্ত : একজন দ্বিগ্বিজয়ী রাজা হিসাবে সমুদ্রগুপ্ত উত্তর এবং দক্ষিণ ভারতে বিজয়াভিযান চালিয়েছিলেন উত্তর ভারতে বিভিন্ন রাজ্য তিনি যেমন সরাসরি যুদ্ধে জয় করেছিলেন, তেমনি আবার এমন অনেক উপজাতি ছিল যারা তাঁর বশ্যতা স্বীকার করে নিয়েছিল উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অনেক রাজা সমুদ্রগুপ্তের রাজনৈতিক ক্ষমতাতে ভয় পেয়ে তাঁর আনুগত্য মেনে নিয়েছিলেন । সমুদ্রগুপ্ত তার সামরিক অভিযান দাক্ষিণাত্যেও পরিচালনা করেছিলেন । অবশ্য তিনি সেখানকার রাজ্যগুলিকে  পরাজিত করলেও তাদের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন । অর্থাৎ উত্তর ভারতের রাজ্যগুলি জয় করে গুপ্ত সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল, কিন্তু দাক্ষিণাত্যে সমুদ্রগুপ্ত এক নতুন নীতি গ্রহণ করেছিলেন। তিনি পাটলিপুত্র থেকে দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্যগুলির দূরত্ব উপলব্ধি করে সেখানকার রাজ্যসমূহকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাননি রাজাদের আনুগত্য লাভ করেই সন্তুষ্ট হন এইখানেই সমুদ্রগুপ্তের রাজনৈতিক বিচক্ষণতা।

গ. শাসক হিসাবে সমুদ্রগুপ্ত : সমুদ্রগুপ্ত কেবল একজন দিগ্বিজয়ী বীর-ই ছিলেন না, একজন বহুমুখী প্রতিভাসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন । বিশাল আয়তনের গুপ্ত সাম্রাজ্য গঠনের পাশাপাশি তিনি সেই  সাম্রাজ্যকে সুন্দরভাবে শাসন করবার ও ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন । সমুদ্রগুপ্ত প্রজাদের কল্যাণার্থেই শাসনকাজ পরিচালনা করতেন । শিল্প-সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক হিসাবেও সমুদ্রগুপ্ত খ্যাতিমান । গুপ্তযুগে হিন্দুধর্মের অভ্যুত্থান ঘটেছিল । আর এই অভ্যুত্থানে অবশ্যই গুপ্তরাজদের অবদান ছিল কিন্তু তাই বলে সমুদ্রগুপ্ত পরধর্মের প্রতি কোনও অসহনীয়তা দেখাননি। বরঞ্চ সমুদ্রগুপ্ত অন্যান্য ধর্মসম্প্রদায়ের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। বাস্তবিকপক্ষে পরধর্মসহিষ্ণুতা গুপ্তরাজের মহত্ত্বের ই পরিচায়ক ।

ঘ. সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক সমুদ্রগুপ্ত :  একজন সংস্কৃতিবান সম্রাট হিসাবে ও সমুদ্রগুপ্ত খ্যাতিমান। তাঁর বীণাবাদনরত মুদ্রা, সিংহ-শিকারের ছাপ দেওয়া মুদ্রা প্রভৃতি থেকে সংস্কৃতিবান মনের পরিচয় পাওয়া যায়। সমুদ্রগুপ্ত গুণীজনের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন । 'এলাহাবাদ প্রশক্তির রচয়িতা হরিষেণ তার সভাকবি ছিলেন। বিদেশীয় রাজাদের সঙ্গেও সমুদ্রগুপ্তের সুসম্পর্ক ছিল ।

এলাহাবাদ প্রশস্তির রচয়িতা হরিষেণ সমুদ্রগুপ্তকে একজন কৃতী শাসক বলে বর্ণনা করেছেন । সমুদ্রগুপ্ত যে জ্ঞানী-গুণী ব্যক্তিদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন হরিষেণ তার-ও উল্লেখ করেছেন । সমুদ্রগুপ্ত নিজেও একজন স্বনামধন্য কবি ছিলেন বলে হরিষেণ মন্তব্য করেছেন। সমুদ্রগুপ্ত বীণাবাদনে পারদর্শী ছিলেন যার প্রমাণ পাওয়া যায় তার প্রচারিত মুদ্রা থেকেই। কারণ মুদ্রায় তিনি বীণা বাজাচ্ছেন এমন ছাপ দেওয়া আছে । শিকার বা মৃগয়া সমুদ্রগুপ্তের খুব প্রিয় ছিল। সমুদ্রগুপ্তের মুদ্রা থেকেও তার প্রমাণ মেলে। 

এইভাবে সমুদ্রগুপ্ত একজন বিজেতা, প্রশাসক এবং সংস্কৃতিবান ব্যক্তি হিসাবে ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে  আছেন ।

৪। প্রশ্ন : দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের কৃতিত্ব আলোচনা কর । অথবা   দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিক্রমাদিত্যের রাজত্বের মূল্যায়ন কর ।  Discuss the achievements of Chandragupta II. Or evaluate the reign of Chandragupta II Vikramaditya.

উত্তর : ক. সূচনা : সমুদ্রগুপ্ত মূলত খ্যাতিলাভ করেছিলেন বিজেতা হিসাবে কিন্তু দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বিজেতা এবং শিল্প-সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক উভয় হিসাবে কীর্তিমান । সমুদ্রগুপ্তের পদাঙ্ক অনুসরণ করে তিনি পর পর রাজ্যজয়ে প্রবৃত্ত হন । তবে এ ব্যাপারে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন এবং যুদ্ধযাত্রা উভয় পন্থা গ্রহণ করেছিলেন ।

খ. বিজেতা দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত : দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত কুবেরনাগ নামে জনৈকা নাগ রাজকন্যাকে বিবাহ করে নাগদের সহায়তায় নিজ শক্তি ও মর্যাদা বৃদ্ধি করেছিলেন । আবার বাকাটক রাজা দ্বিতীয় রুদ্রসেনের সঙ্গে নিজ কন্যা প্রভাবতীর বিবাহ দিয়ে দাক্ষিণাত্যের শক্তিশালী শাসকগোষ্ঠীর বন্ধুত্ব লাভ করেছিলেন। অপরদিকে শকদের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত এক দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিলেন। শকদের রাজা তৃতীয় রুদ্রসিংহকে পরাজিত করে তিনি গুপ্ত সাম্রাজ্যের ক্ষমতা ও প্রভাব-প্রতিপত্তি অনেকখানি বাড়িয়ে নিয়েছিলেন। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত শকরাজ তৃতীয় রুদ্রসিংহের মুদ্রায় নিজের নামাঙ্কন করে পুনঃপ্রচার করেছিলেন । এই ঘটনা থেকেও বলা যায় যে, শকরা তাঁর হাতে পরাজিত হয়েছিলেন ।

যাই হোক, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত একজন বিজেতা হিসাবে যে যথেষ্ট সফলতা অর্জন করেছিলেন তাতে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, দিল্লীর অনতিদূরে মেহেরৌলিতে (কুতব মিনারের নিকটে) যে লৌহ-স্তম্ভ আছে তার নির্মাতা যদি দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত হয়ে থাকেন তাহলে বলতে হয় যে তিনি উত্তর-পূর্ব ভারতের অনেকটা এলাকা (বাংলাদেশ সমেত) দখল করে নিয়েছিলেন।

গ. দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত 'বিক্রমাদিত্য' : দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সময়কার দেশের অবস্থা জানবার সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য উপাদান হল চীনদেশীয় ভ্রমণকারী ফা-হিয়েনের বিবরণ । কারণ তিনি ঐ সময়েই ভারত ভ্রমণে এসেছিলেন । দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত সম্রাট হিসাবে ‘বিক্রমাদিত্য' উপাধি গ্রহণ করেছিলেন । ইতিহাসে অপর একজন বিক্রমাদিত্যের নাম পাওয়া যায় যিনি কিংবদন্তীর । এখন ঐতিহাসিকদের ধারণা কিংবদন্তীর বিক্রমাদিত্য আসলে গুপ্তসম্রাট দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত ব্যতীত আর কেউ নন । দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজসভায় কালিদাস, ভবভূতি, বরাহমিহির প্রভৃতি নয়জন ‘রত্ন’ অর্থাৎ মনীষী ব্যক্তি আসন গ্রহণ করতেন । যে কারণে ঐ সভাকে ‘নবরত্ন সভা' বলা হত । সবশেষে বলা যেতে পারে যে, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত শাসক হিসাবেও প্রতিভার পরিচয় দিয়েছিলেন । তাছাড়া তাঁর রাজত্বকালে গুপ্ত সাম্রাজ্য যে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে খুবই উন্নতি করেছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় সেযুগের সুবর্ণমুদ্রার মান থেকে এইভাবে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত সকল দিক দিয়েই কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন । যে কারণে তাঁকে গুপ্তবংশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সম্রাট বলা হয়। 

ঘ. বহুতর মুদ্রার প্রচারক :  সমুদ্রগুপ্ত মুদ্রার প্রচারক হিসাবে খ্যাতিমান ছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের প্রচারিত মুদ্রার সংখ্যা ছিল তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি । কেবল তা-ই নয়, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তই ছিলেন শুগুরাজদের মধ্যে প্রথম যিনি রৌপ্যমুদ্রার প্রচলন করেন। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত যেসব মুদ্রা প্রচলন করেছিলেন তার বৈশিষ্ট্য ছিল এই যে, মুদ্রাগুলিতে দেখা যায় নারী-দেবতারা সিংহাসনের পরিবর্তে পদ্মপাপড়ির উপর উপবিষ্ট । যাই হোক, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত প্রচারিত রৌপ্যমুদ্রা তাঁর বংশধরদের আমলেও প্রচলিত ছিল ।

এইভাবে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত একজন বিজেতা অপেক্ষা একজন সর্বগুণসম্পন্ন রাজা হিসাবেই ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে আছেন ।

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.