রাজনৈতিক ঐক্যের যুগ | The era of political unity (PART-3)

রাজনৈতিক ঐক্যের যুগ | The era of political unity (PART-3)


 ১। প্রশ্ন: গুপ্ত সাম্রাজ্যের শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে যা জান সংক্ষেপে লেখ। Write briefly what you know about the rule of the Gupta Empire.

উত্তর। ক। সূচনা : গুপ্তসম্রাটরা সাম্রাজ্যবাদী হিসাবে অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করতেন। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে গুপ্তসম্রাটরা, বিশেষত সমুদ্রগুপ্ত বিজয়াভিযান চালিয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও তাঁদের আমলে প্রাদেশিক শাসনকর্তা বা অনুগত রাজারা প্রায়শই নিজেদের স্বাধীনতা ঘোষণা করবার জন্য উদগ্রীব ছিলেন। গুপ্তসম্রাটরা স্বৈরাচারী ও সাম্রাজ্যবাদী ছিলেন। 

খ. কেন্দ্রীয়, প্রাদেশিক ও গ্রাম-শাসন : গুপ্ত শাসনব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকার বলতে রাজাকেই বোঝাত। তিনি ছিলেন সর্বক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তি । রাজপরিবারের সদস্যরা রাজাকে সাহায্য করতেন। 

তাছাড়া রাজকর্মচারীরা দায়িত্বশীল পদে থেকে রাজকার্য পরিচালনায় সাহায্য করতেন । গুপ্তযুগে এক একজন সরকারী কর্মচারীর হাতে নানা ধরনের ক্ষমতা ন্যস্ত ছিল। সমগ্র গুপ্ত সাম্রাজ্যকে কতকগুলো প্রদেশ বা ‘ভুক্তিতে বিভক্ত করা হয় । প্রদেশকে আবার কয়েকটি জেলা বা ‘বিষয়’তে ভাগ করা হয়েছিল। শাসনকাজে সুবিধার জন্য । গ্রাম-শাসনের ক্ষেত্রে গুপ্তযুগে কয়েকটি বিশিষ্টতা লক্ষ্য করা যায়। প্রধান গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সহায়তায় শাসনকাজ পরিচালনা করতেন ।

গ. নগর শাসন ও গিল্ড ব্যবস্থা : গ্রাম প্রধান যেমন গ্রামের পরিচালনা করতেন স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সাহায্য নিয়ে, তেমনি নগর প্রধান নগরের শাসন পরিচালনায় স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সাহায্য নিতেন। তাছাড়া নগর শাসনে স্থানীয় কারিগর, ব্যবসায়ী, শ্রমিক প্রভৃতির সংগঠনের প্রতিনিধিত্ব থাকত। মালবের মান্দোসারে সিল্ক-বয়নকারীরা পর্যন্ত তাদের সমবায় বা গিল্ড গঠন করেছিল। সমবায়ের সদস্যরা। নিজেদের পারস্পরিক সুবিধা-অসুবিধাগুলো যেমন দেখত, তেমনি শাসন ব্যাপারেও অংশগ্রহণ করত ।

ঘ. বিচার-ব্যবস্থা : আগেকার তুলনায় গুপ্ত আমলে বিচার-ব্যবস্থার অনেক উন্নতি ঘটেছিল। সেযুগে যে নানা ধরনের আইন-গ্রন্থ রচিত হয়েছিল তা থেকেই এর প্রমাণ পাওয়া যায় গুপ্তযুগেই প্রথম দেওয়ানী এবং ফৌজদারী আইন-কানুন পৃথক করা হয়েছিল । জমিজমা সংক্রান্ত বিষয়গুলো দেওয়ানী মামলার অন্তর্গত এবং চুরি-ডাকাতি, হত্যা প্রভৃতি আসে ফৌজদারী মামলার আওতায় ।

ঙ। দান-প্রথা : গুপ্তযুগের অপর একটি বৈশিষ্ট্য ছিল দান-প্রথা । ব্রাহ্মণ এবং পুরোহিতদের জমিজমা দান করা হত এইসব দান করা জমির ওপর সরকার কোনও প্রকার রাজস্ব বা কর ধার্য করতেন না। তবে সেই জমিতে যেসব চাষী চাষ-আবাদ করত তাদের কর দান করতে হত সেই জমির মালিককে অর্থাৎ গ্রহণকারী ব্যক্তিকে সরকারী কাজকর্মে নিযুক্ত ব্যক্তিদের সম্ভবত জমি দান করবার প্রথা প্রচলিত ছিল না সকলেই সরকারের কাছ থেকে নগদ টাকায় বেতন লাভ করতেন। 

এইভাবে গুপ্ত শাসনব্যবস্থায় মৌর্যদের মতো আমলাতন্ত্রের প্রভাব তেমন লক্ষ্য করা যায় না । তবে যে নতুন বৈশিষ্ট্য গুপ্ত শাসনব্যবস্থাকে চিহ্নিত করেছিল তা হল সামন্ততান্ত্রিক প্রবণতা। 

২। প্রশ্ন : গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের কারণগুলি কি কি ?  What are the causes of the fall of the Gupta Empire?

উত্তর: ক. সূচনা : গুপ্তসম্রাট সমুদ্রগুপ্ত এবং দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের অসাধারণ প্রতিভার ফলে যে বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল তা পঞ্চম শতকের শেষভাগ থেকে দ্রুত পতনের দিকে ধাবিত হয় । বস্তুত বুধগুপ্তের পরে আর কোনও গুপ্তসম্রাট-ই গঙ্গা এবং নর্মদা নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চলের ওপর আধিপত্য বজায় রাখতে পারেননি । বলা বাহুল্য গুপ্তবংশের দুর্বলতার জন্যই তা আর সম্ভব হয়নি। অবশ্য গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের জন্য আরও অনেক কারণ-ই দায়ী ছিল । যথা : অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ, বহিরাগত আক্রমণ, রাজপরিবারের দুর্বলতা, সামরিক দুর্বলতা প্রভৃতি ।

খ. অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ : স্কন্দগুপ্তের পরবর্তী গুপ্তরাজরা সাম্রাজ্যের শক্তি এবং নিরাপত্তা রক্ষা করবার মতো ক্ষমতা ধরতেন না। তাঁদের রাজত্বকালে তাই অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ যেমন দেখা দিয়েছিল, তেমনি বহিরাগত শত্রুরাও সুযোগ বুঝে সাম্রাজ্যের ওপর ঝাপিয়ে পড়ছিল। কুমারগুপ্ত যখন সম্রাটপদে আসীন তখন পুষ্যমিত্র নামে এক দুর্ধর্ষ জাতি বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল। যুরাজ স্কন্দগুপ্ত এদের পরাজিত করেছিলেন ঠিকই, কিন্তু অল্পকালের মধ্যেই হূনদের আক্রমণে পুনরায় গুপ্ত সাম্রাজ্য বিধ্বস্ত হয় ।

গ. হূন আক্রমণ : গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের জন্য ঐতিহাসিকদের অনেকে হূন আক্রমণকে বড় করে দেখেছেন। একথা অনস্বীকার্য যে বৈদেশিক আক্রমণ সাম্রাজ্যকে যেভাবে আঘাত করে তা সহজে কাটিয়ে ওঠা যায় না। স্কন্দগুপ্ত বা নরসিংহগুপ্ত হূনদের পরাজিত করেছিলেন ঠিকই । কিন্তু হূন আক্রমণের  এই আঘাত কাটিয়ে ওঠবার আগেই মালবের যশোধর্মন নিজেকে শক্তিশালী করে নিয়ে গুপ্তদের ওপর কাঁপিয়ে পড়েন। যশোধর্মনের রাজত্বকাল খুব কম সময়ের জন্য হলেও তাঁর এই আক্রমণ গুপ্ত সাম্রাজ্যকে গভীরভাবে আঘাত করেছিল ।

ঘ. কেন্দ্রীয় শাসনের দুর্বলতা :  গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের অপর একটি কারণ ছিল কেন্দ্রীয় শাসনের দুর্বলতার সুযোগে প্রাদেশিক শাসনকর্তা এবং সামস্তরাজদের স্বাধীনতা ঘোষণার ইচ্ছা। গুপ্তসম্রাটদের অধীন বিভিন্ন এলাকার যেমন সমতট (বা দক্ষিণ-বঙ্গ), বিহার প্রভৃতি প্রদেশের প্রাদেশিক শাসনকর্তা বা সামস্তরা শক্তিশালী হয়ে উঠে স্বাধীন রাজার মতো আচরণ করতে শুরু করেছিলেন। আর গুপ্তসম্রাটদের ক্ষমতা তখন এমন ছিল না যে তারা আবার সেখানে ক্ষমতা প্রয়োগ করেন । এমতাবস্থায় গুপ্ত সাম্রাজ্য চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলার মধ্যে ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যেতে শুরু করেছিল।

ঙ. সামরিক দুর্বলতা : গুপ্ত সাম্রাজ্য যে সামরিক কারণে ধ্বংস হয়েছিল তার মূল কথা ছিল নিজস্ব বাহিনীর অভাব । অর্থাৎ যুদ্ধকালে সৈন্য সরবরাহের জন্য সর্বদা সামন্তদের উপর নির্ভরশীল থাকার ফলে সুযোগ বুঝে এক সময় সামস্তরা সর্বেসর্বা হয়ে উঠেছিল । সামরিক এই দুর্বলতার পাশাপাশি অর্থনৈতিক দুর্বলতার কথাও উল্লেখ করতে হবে । পঞ্চম শতকের শেষদিকে রোম সাম্রাজ্যের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাওয়ার দরুন গুপ্তদের আর্থিক অসুবিধা দেখা দিয়েছিল ।

এইভাবে নানাবিধ কারণের সমষ্টিগত ফল হিসাবেই গুপ্ত সাম্রাজ্য পতনের দিকে এগিয়ে চলেছিল  এবং  এক সময় তার আর চিহ্ন কিছু অবশিষ্ট ছিল না ।

৩। প্রশ্ন: গুপ্তযুগে ভারতীয় সমাজ ও অর্থনীতির সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও । Give a brief introduction of Indian society and economy in the Gupta period.  

উত্তর : ক. সামাজিক অবস্থা:  গুপ্তযুগে ভারতীয় সমাজে ব্রাহ্মণদের প্রাধান্য স্বীকৃত ছিল। অবশ্য সমাজের এই বৈশিষ্ট্য নতুন কোনও ব্যাপার নয়। আগেও যেমন ছিল গুপ্তযুগেও তেমনি ব্রাহ্মণরা সমাজের মাথা বলে মেনে নিয়েছিল সকলেই । গুপ্তরাজরা ব্রাহ্মণদের এই সামাজিক আধিপত্যের সমর্থক ছিলেন। তাদের দেওয়া দানপত্র থেকে এর সমর্থন পাওয়া যায়। ব্রাহ্মণরা ভূমিদানপত্রের মাধ্যমে প্রভূত সম্পত্তি অর্জন করেন। তাছাড়া অপরাপর নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধাও তারা ভোগ করতেন ।

তখনকার সময়ে ভারতবর্ষীয় সমাজের অপর একটি বৈশিষ্ট্য ছিল বিভিন্ন বিদেশী জাতিকে ভারতের সমাজ কাঠামোতে স্থান দেওয়া। অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র প্রভৃতি জাতিতে বিভক্ত সমাজে বিদেশীরা কোন্ শ্রেণীভুক্ত হবে তা নির্ধারণ করে অন্তর্ভুক্ত করে নেওয়া। বিদেশীরা বিজেতা হিসাবে ভারতবর্ষে এসেছিল ; এবং তাদের যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শিতা ছিল। যে কারণে বিদেশীরা ক্ষত্রিয় হিসাবেই সমাজে স্থান পেয়েছিল । কেবল বিদেশীরা-ই নয়, অনেক উপজাতির মানুষ ও হিন্দু সমাজের মূল স্রোতের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল ।

গুপ্তযুগে শূদ্রদের অবস্থার উন্নতি ঘটেছিল । উদাহরণ হিসাবে বলা যায় যে, শূদ্ররা তখন আর আগেকার মতো মহাভারত, রামায়ণ, পুরাণ প্রভৃতির কাহিনী শোনা থেকে বঞ্চিত ছিল না । তবে চণ্ডাল বা অস্পৃশ্যদের সামাজিক অবস্থা আগের থেকে অনেক নিচে নেমে গিয়েছিল । অস্পৃশ্যদের ছায়া মাড়ানো ও পাপকাজের সমান বলে মনে করা হত । সমাজে নারীদের স্থান উন্নত ছিল বলে অনেকে মনে করেন তবে সতীদাহ প্রথা এই সময় থেকে শুরু হয়েছিল বলে অনেকে সমাজে নারীদের উন্নতির কথা মানতে রাজী নন ।

খ. অর্থনৈতিক অবস্থা : গুপ্তযুগের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিচয় পাওয়া যায় ফা-হিয়েনের বর্ণনা থেকে। তিনি ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করেছিলেন বলে তার বিবরণীতে সমগ্র ভারতের চিত্রটাই  ফুটে উঠেছে । গুপ্তযুগের প্রথম দিকে, অর্থাৎ স্কন্দগুপ্ত পর্যন্ত সাম্রাজ্যের অর্থনীতি ছিল উন্নত মানের। তখন ব্যবসা-বাণিজ্য ভালভাবেই চলছিল । বিদেশ থেকে অর্থাগম হচ্ছিল প্রচুর। কিন্তু পরবর্তী কালে এই সমৃদ্ধি আর লক্ষ্য করা যায় না। একদিকে বিদেশী আক্রমণ প্রতিহত করতে অকারণ অর্থব্যয় হচ্ছিল। আবার যুদ্ধ-বিগ্রহে ফসল উৎপাদন ও ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাহত হওয়ায় সাম্রাজ্যের আর্থিক অবস্থার অবনতি হয়েছিল । আরও একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল এই যে, বর্বর আক্রমণে রোম সাম্রাজ্যের পতন ঘটবার ফলে ভারতের সঙ্গে রোম-এর ব্যবসা-বাণিজ্যের অবসান হয় । অর্থনৈতিক অবনতি এই কারণে ঘটা খুবই স্বাভাবিকভাবে ঘটে গিয়েছিল ।

এইভাবে বলা যায় যে, গুপ্ত আমলে ভারত সামাজিক ও আর্থনীতিক দিক দিয়ে কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছিল ।

৪। প্রশ্ন : গুপ্তযুগকে ভারতের সুবর্ণযুগ বলা হয় কেন ? Why is the Gupta age called the golden age of India?

ক. সূচনা : ভারতের ইতিহাসে গুপ্তযুগ এক গৌরবময় অধ্যায় বলে বিবেচিত হয়ে থাকে। এই যুগে গুপ্তবংশীয় রাজারা যে সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন তার আয়তন ছিল বিশাল । বহুতর রাজা গুপ্তসম্রাটদের আনুগত্য মেনে চলতেন শাসনদক্ষতায়ও গুপ্তরা কারো তুলনায় কম কৃতিত্ব দেখাননি। আবার সাহিত্য-সংস্কৃতিতেও সেযুগ চরম উন্নতি করেছিল মূলত সাহিত্য-সংস্কৃতির উৎকর্ষের জন্যই গুপ্তযুগকে ‘সুবর্ণযুগ' বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে ।

খ. সাহিত্যের উন্নতি : গুপ্ত আমলে বিখ্যাত সব কবি, সাহিত্যিকরা আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাঁরা তাঁদের রচনার দ্বারা সেযুগকে সমৃদ্ধ করেছিলেন সমসাময়িক ভারতের শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন কালিদাস। তাঁর ‘অভিজ্ঞান শকুস্তলম’, ‘মেঘদূত’ প্রভৃতির সাহিত্যমূল্য আজ-ও এতটুকু কমেনি । গুপ্তযুগের অপরাপর সাহিত্যসেবীদের মধ্যে আছেন ‘মৃচ্ছকটিকম’ প্রণেতা শূদ্রক; ‘মুদ্রারাক্ষস’ প্রণেতা বিশাখদত্ত; ‘এলাহাবাদ প্রশস্তি’র রচয়িতা হরিষেণ প্রভৃতি।

গ. জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা : সাহিত্য ব্যতীত গণিত শাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা প্রভৃতি ক্ষেত্রেও গুপ্তযুগ উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে গিয়েছে। আর্যভট্ট, বরাহমিহির প্রমুখ মনীষীর অবদানে গুপ্তযুগ পুষ্ট হয়েছিল । আর্যভট্ট ছিলেন পাটলিপুত্রের বাসিন্দা । তাঁর রচিত গ্রন্থের সঠিক সংখ্যা নির্ণয় করা সম্ভব না হলেও একথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে, তাঁর ‘আর্যভট্টীয়’ গ্রন্থখানি গণিতশাস্ত্র এবং জ্যোতির্বিদ্যা সংক্রান্ত নানা তথ্যে পরিপূর্ণ । বরাহমিহির মূলত ছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী । তিনি ‘রোমক সিদ্ধান্ত’ রচনা করে খ্যাতিমান হন । গুপ্তযুগে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিবিদ্যায় যে কারিগররা বিশেষ উন্নতি করেছিল তার-ও প্রমাণ আছে। ব্রোঞ্জ এবং লোহা, এই দুটিই ধাতু হিসাবে বেশি ব্যবহৃত হত, এবং কারিগররা এইসব বিদ্যায় পারদর্শিতা অর্জন করেছিলেন । দিল্লীর অন্তর্গত মেহেরৌলির লৌহস্তম্ভ সেসময়কার ধাতুশিল্পীদের উন্নত মানের পরিচয় দেয় ।

ঘ. সাংস্কৃতিক অগ্রগতি : শিল্পকলার ক্ষেত্রে-ও যে গুপ্তযুগ যথেষ্ট উন্নতির পরিচয় দিয়েছিল সমসাময়িক নিদর্শনগুলি থেকে তার প্রমাণ পাওয়া যায় । শিল্পকলার তিনটি শাখা—স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্রকলাতে গুপ্তযুগে শিল্পীরা পারদর্শিতা দেখিয়েছিলেন । গুপ্ত স্থাপত্য এবং ভাস্কর্যের অনবদ্য সৃষ্টি হল ঝান্সি জেলায় দেওগড়ের মন্দির, কানপুরে ভিটারগাঁও প্রভৃতি। চিত্রকলার ক্ষেত্রে অজন্তা এবং ইলোরার গুহাচিত্রসমূহ আজও দর্শকদের বিস্ময়ের বস্তু । 

এইভাবে গুপ্তযুগ সাম্রাজ্য গঠন থেকে শুরু করে শিল্পকলা সব ক্ষেত্রেই চরম উন্নতির পরিচয় - দিয়েছিল । যে কারণে এই যুগকে গ্রীক ইতিহাসের পেরিক্লিসের যুগ অথবা ইংলণ্ডের ইতিহাসের  এলিজাবেথের যুগের সঙ্গে তুলনা করা হয়ে থাকে। আবার সাম্রাজ্যের সর্বাঙ্গীণ উন্নতির জন্য গুপ্তযুগকে ভারত ইতিহাসের সুবর্ণযুগ বলেও অনেকে অভিহিত করে থাকেন । তবে কোনও কোনও ঐতিহাসিক এবিষয়ে আপত্তি জানিয়েছেন ।

৫।  প্রশ্ন : সাতবাহনশ্রেষ্ঠ গৌতমীপুত্র সাতকর্ণীর কৃতিত্ব কি ছিল ? অথবা  সাতবাহনদের মধ্যে যিনি শ্রেষ্ঠ তাঁর কৃতিত্ব আলোচনা কর । What was the achievement of ‎Gautamiputra Satakarni , the greatest king of Satavahana? Or  Discuss the achievements of the greatest king of Satavahana.

উত্তর : ক. সূচনা : দাক্ষিণাত্যে সাতবাহন বংশের উত্থান বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এদের সময় থেকেই ভারতের ইতিহাসে দাক্ষিণাত্যের ভূমিকা গ্রহণ শুরু হয় । সাতবাহনদের নাম ‘অন্ধ্র’-ও ছিল বলে ঐতিহাসিকদের ধারণা। আবার অনেকে বলেছেন যে সাতবাহনরা এসেছিল অন্ধ্র থেকে । সাতবাহনরা এক সময়ে মৌর্যদের হয়ে শাসনকাজে লিপ্ত ছিল। মৌর্য রাজবংশের দুর্বলতার সুযোগে তারা নিজেদের স্বাধীন বলে ঘোষণা করে । সাতবাহনদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিলেন গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী

খ. বিজেতা গৌতমীপুত্র : প্রথম দিকের সাতবাহন নৃপতিদের প্রতাপ ও প্রতিপত্তি শকদের মহরত শাখার দাপটে লুপ্ত হয়েছিল সেই লুপ্তগৌরবকে পুনরুদ্ধার করেছিলেন গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী । ১০৬ থেকে ১৩০ খ্রীস্টাব্দ, এই চব্বিশ বছর রাজত্বকালে গৌতমীপুত্র সাতকর্ণীর প্রধান কৃতিত্ব ছিল লুপ্তগৌরব  ফিরিয়ে আনা । তাছাড়া তিনি নতুন নতুন অনেক এলাকা জয় করে সাতবাহনদের মর্যাদাকে আরও বৃদ্ধি করেছিলেন শকনেতা নহপানকে পরাজিত করে গৌতমীপুত্র তার-ই মুদ্রার অপর পৃষ্ঠে নিজস্ব ছাপ ব্যবহার করেছিলেন নতুন বিজিত এলাকার মধ্যে গুজরাট, মালব, সৌরাষ্ট্র, বেরার, উত্তর কোঙ্কন প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য । গৌতমীপুত্রের রাজনৈতিক প্রভাব মালব থেকে কর্ণাটক পর্যন্ত সুবিস্তৃত ছিল । এইভাবে গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী বিজেতা হিসাবে শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী ছিলেন। 

গ. সমাজ-সংস্কারক গৌতমীপুত্র : গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী বিভিন্ন এলাকা জয় করবার ফলে লক্ষ্য করেছিলেন যে শক, যবন প্রভৃতি নানা বিদেশীরা-ও সাতবাহন সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে পড়েছে। কেবল তা-ই নয়, ঐসব বিদেশীরা ভারতীয় সবকিছু গ্রহণ করে এদেশের মানুষ-ই হয়ে গিয়েছিল যেন । এমতাবস্থায় এইসব ভারতীয় হয়ে যাওয়া বিদেশীদের ভারতীয় সমাজের অন্তর্ভুক্ত করবার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিল। এইসব বিদেশীরা ক্ষত্রিয় হিসাবে সমাজে স্থান লাভ করেছিল । যদিও গৌতমীপুত্র নিজেকে একজন ব্রাহ্মণ হিসাবেই পরিচয় দিতেন। ক্ষত্রিয়রা দেশশাসনের কাজ করতেন, কিন্তু রাজা হয়েও তিনি যে ব্রাহ্মণ বলে পরিচয় দিতেন তাতেই বোঝা যায় যে গৌতমীপুত্রের সময়ে জাতিভেদ প্রথা ততটা প্রকট হয়ে ওঠেনি দাক্ষিণাত্যে ।

ঘ. শাসক হিসাবে গৌতমীপুত্র : অপরাপর সাতবাহন রাজাদের ন্যায় গৌতমীপুত্র সাতকর্ণীও নিজেকে প্রাচীন ভারতীয় দেবতাদের মতো শক্তিশালী বলে প্রমাণ করতেন । নিজের ওপর দেবত্ব আরোপ করতে গিয়ে তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে, রাম, অর্জুন, ভীম প্রভৃতির মতো গুণাবলীর অধিকারী তিনি । একজন শাসক হিসাবেও গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী সফলতা অর্জন করেন । অবশ্য এ বিষয়ে তিনি মৌর্যদের শাসনব্যবস্থার কয়েকটি বৈশিষ্ট্য অনুকরণ করেছিলেন। যেমন মৌর্যদের মতো সাতবাহনদের প্রদেশগুলিরও নাম ছিল ‘অহর’ । সাতবাহনদের শাসনব্যবস্থার অপর একটি বৈশিষ্ট্য ছিল সামরিক কর্মচারীদের শাসক হিসাবে নিয়োগ করা সেনাপতি, গৌলমিকা প্রভৃতি পদস্থ সামরিক কর্মচারীরা শাসক হিসাবে দায়িত্ব পালন করতেন ।

এইভাবে গৌতমীপুত্র সাতকর্ণী সাতবাহন শক্তিকে যে ক্ষমতাশালী করে তুলেছিলেন তা দীর্ঘদিন পর্যন্ত টিকে থাকেনি । তাঁর মৃত্যুর অল্পদিনের মধ্যেই সাতবাহন শক্তি পুনরায় ধ্বংসের পথে অগ্রসর হয় নানা কারণে । গৌতমীপুত্র সাতকর্ণীর আগে বা পরে কোনও সময়ে-ই আর তার মতো ক্ষমতাসম্পন্ন রাজা সাতবাহন সিংহাসনে বসেননি বলে তাঁকেই সাতবাহনশ্রেষ্ঠের মর্যাদা দেওয়া হয়। 

Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.