বাংলার নীল বিদ্রোহ || Indigo revolt in Bengal

বাংলার নীল বিদ্রোহ || Indigo revolt in Bengal


 বাংলার নীল বিদ্রোহ | Indigo Revolt in Bengal

নীলচাষ বিরোধী আন্দোলনের সূচনা হয় এবং দ্রুত সমগ্র বাংলায় এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। বিদ্রোহের পিছনে কাজ করে অর্ধ শতাব্দী ধরে নীল চাষীদের উপরে নির্মম নিপীড়ন ও নীল চাষ আইন প্রণয়ন।[১][২]

ভারত উপমহাদেশের মাটি নীল চাষের জন্য বিশেষ উপযোগী হওয়ায় বৃটিশ নীলকরেরা নীলচাষে বিপুল পুঁজি বিনিয়োগ করে। নদীয়া, যশোর, বগুড়া, রংপুর প্রভৃতি জেলায় নীলচাষ শুরু হয়। ঊনিশ শতকের শেষের দিকে নীলচাষ অর্থনৈতিক ভাবে লাভজনক না হওয়ায় কৃষকরা ধান ও পাট চাষের দিকে ঝুঁকে পড়ে। বৃটিশ নীলকরেরা অত্যাচার আর নিপীড়নের মাধ্যমে নীলচাষে বাধ্য করলে আন্দোলন গড়ে ওঠে। এরই ধারাবাহিকতায় এক পর্যায়ে বাংলায় নীল চাষ বিলুপ্ত হয়।

প্রথমদিকে নীল চাষ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একচেটিয়া অধিকারে ছিল। ১৮৩৩ সালের সনদ আইনের ফলে তাদের একচেটিয়া অধিকার লোপ পায় এবং ব্রিটেন থেকে দলে দলে ইংরেজ নীলকররা বাংলায় আগমন করে ইচ্ছামত নীলের চাষ শুরু করে। তখন থেকেই কৃষকদের ওপর অত্যাচার শুরু হয়। ফলে ১৮৫৯ ফেব্রুয়ারী – মার্চ মাসে নীলচাষীরা সঙ্ঘবদ্ধভাবে নীল চাষ করতে অস্বীকৃতি জানায়। প্রথমদিকে এই আন্দোলন অহিংস ছিল, কিন্তু নীলচাষ না করার কারণে চাষীদের ওপর ভয়ানক নির্যাতন, গ্রেপ্তার শুরু হলে এ আন্দোলন সশস্ত্র বিদ্রোহে পরিণত হয়। এই বিদ্রোহ বাংলার প্রধান ধর্মীয় গোষ্ঠীদেরও সমর্থন লাভ করে, বিশেষত চাঁদপুরের হাজি মোল্লা, যিনি ঘোষণা দেন নীলচাষ থেকে ভিক্ষা উত্তম।[২][৩]


নীল বিদ্রোহ দমন করার জন্য ইংরেজ সরকার ১৮৬০ সালে 'নীল কমিশন' গঠন করে। এই কমিশন সরেজমিনে তদন্ত করে চাষিদের অভিযোগ যথার্থ বলে অভিমত দেয়। ফলে সরকার নীলচাষের ওপর একটি আইন পাস করেন। এতে ১৮৬২ সালে নীল বিদ্রোহের অবসান হয়। ১৯০০ সালের মাঝে নিশ্চিন্তপুরের নীলকুঠি উঠে যাওয়ার মাধ্যমে বাংলায় সম্পূর্ণভাবে নীলচাষের অবসান ঘটে।[৪]


প্রাচীন ও আধুনিক নীলচাষ

প্রাচীন কাল থেকেই বাংলায় নীল চাষ প্রচলিত ছিল। ভারতীয় ভেষজ বিজ্ঞানের নানা গ্রন্থে, প্রাচীন প্রতিমূর্তির বর্ণে, অঙ্কিত পট ও চিত্রে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। ইংরেজিতে নীল indigo নামে আর গ্রিক ও রোমান ভাষায় indicum নামে পরিচিত। উভয় শব্দই india শব্দের সমার্থবোধক। আবার প্রাচীন দ্রাবিড় গোষ্ঠীর মাঝে নীলের ব্যবহার প্রচলিত ছিল। তারা সিন্ধু নদের (the indus) তীরে বাস করত। এজন্য ধারণা করা হয় এদেশেই নীল চাষের উৎপত্তি। [৫]


লুই বোনার্ড নামের একজন ফরাসি বণিকের মাধ্যমে এদেশে আধুনিক পদ্ধতিতে নীলচাষ ও এর ব্যবহার প্রচলন ঘটে। তিনি ১৭৭৭ সালে আমেরিকা থেকে প্রথম নীলবীজ ও আধুনিক চাষের পদ্ধতি এদেশে নিয়ে আসেন। একই বছরে হুগলী নদীর তীরবর্তী গোন্দালপাড়া ও তালডাঙ্গা গ্রামে তিনি সর্বপ্রথম নীলকুঠি স্থাপন করেন। [৬] এর কয়েক বছর পরে মালদহে, ১৮১৪ সালে বাকিপুরে, এবং তারপরে যশোরের নহাটা ও কালনাতে নীলকুঠি ও কারখানা স্থাপন করেন। ১৮২০ সালে কালনা থেকে প্রায় দেড় হাজার মণ পরিশোধিত নীল রপ্তানি করে বন্ড উপমহাদেশ ও ব্রিটেনে চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেন। ১৮২০ সালে তার মৃত্যু হয়। [৭]


বাংলায় নীলচাষের প্রসার

লুই বোনার্ড এক বছর পর ক্যারল ব্লুম নামের একজন ইংরেজ কুষ্টিয়ায় একটি নীলকুঠি স্থাপন করেন। [৮] তিনি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে নীলচাষে বিপুল মুনাফার কথা অবহিত করে দ্রুত নীলের কারবার শুরু করার আহ্বান জানান ও ১৭৭৮ সালে গভর্নর জেনারেলের কাছে এই বিষয়ে সপারিষদ একটি স্মারকপত্র দাখিল করেন।[৯] অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লবের ফলে বস্ত্রশিল্পের অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হয় এবং কাপড় রং করার জন্য নীলের চাহিদা শতগুনে বেড়ে যায়। ফলে ওই সময়ে নীল চাষের ব্যবসা অত্যন্ত লাভজনক হয়ে ওঠে।


কোম্পানি লাভের সম্ভাবনা দেখে শীঘ্রই সমস্ত কারবার হস্তগত করে নেয়। এক হিসাব থেকে দেখা যায়, ১৮০৩ সাল পর্যন্ত নীল চাষে যে খরচ হত, তার সবটাই কোম্পানি অল্প সুদে অগ্রিম প্রদান করত। এতে যে নীল উৎপাদিত হত, তার সবটাই যেত ইংল্যান্ডে এবং কোম্পানি বহুগুণ বেশি লাভ করত। এই ব্যবসা এতই লাভজনক ছিল যে, বহু কর্মচারী ও সরকারি আমলা চাকরি ও রাজনীতি ছেড়ে নীলচাষের কারবারে আত্মনিয়োগ করে। বহু দেশীয় জমিদার ও মহাজন ব্যক্তিগতভাবে বা যৌথ মালিকানায় কারবার খোলে এবং ১৮১৫ সালের মধ্যে নদীয়া, যশোর, খুলনা, ২৪ পরগণা, বগুড়া, রাজশাহী, মালদহ, পাবনা, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, বরিশাল প্রভৃতি জেলায় অসংখ্য নীলকুঠি গড়ে ওঠে। এসব এলাকার নীলের খ্যাতি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। মধ্যবঙ্গের উৎকৃষ্ট নীলের ব্যবসা করে রাতারাতি ধনী হবার কাহিনি সকল ধনিক ও বণিক সম্প্রদায়কে আকৃষ্ট করে এবং ক্রমশ ফরাসি, ডাচ, পর্তুগীজ, দিনেমার প্রভৃতি দেশের ধনিক গোষ্ঠীও দলে দলে বাংলাদেশে পাড়ি জমায়। [১০]


নীল চাষের প্রসার দেখে বাংলার শীর্ষস্থানীয় মুৎসুদ্দি, নব প্রতিষ্ঠিত জমিদার গোষ্ঠী ও উদীয়মান শহুরে শ্রেণী নীলকরদের সুযোগ-সুবিধা ও নীলচাষের প্রসারের জন্য আন্দোলন শুরু করে। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল ইংরেজ সরকারের সুনজরে থাকা। এদের মাঝে প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, রাজা রামমোহন রায় অন্যতম। তারা ১৮২৯ সালের ১৫ই ডিসেম্বর কলকাতার টাউন হলে এক সভা করেন এবং নীল চাষ প্রসারের দাবি জানিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কাছে সুপারিশ পাঠান। পার্লামেন্ট তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে দাস মালিক ও দাস পরিচালনাকারীদের বাংলায় এনে নীলচাষের তদারকিতে নিয়োজিত করে। এছাড়া ব্যাপক নীল চাষের কারণে বিহার ও উড়িষ্যা পর্যন্ত রাজ্য বিস্তার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। এই উদ্দেশ্যে ইংরেজরা আগ্রা ও অযোধ্যা দখল করে। [৯]


বাংলাদেশের ২০ লক্ষ ৪০ হাজার বিঘা জমিতে ১২ লক্ষ ৮০ হাজার মণ নীল উৎপন্ন হত। বাংলায় ১১৬টি কোম্পানি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ৬২৮টি সদর কুঠির অধীনে সর্বমোট ৭৪৫২টি নীলকুঠি ছিল (ব্যক্তিগত ও দেশীয় জমিদার-মহাজনদের কুঠি বাদে)। নীলচাষে কর্মরত ছিল ১ কোটি ১২ লক্ষ ৩৬ হাজার কৃষক এবং নীলকুঠিগুলোতে নিযুক্ত কর্মচারীর সংখ্যা ছিল ২ লক্ষ ১৮ হাজার ৪শ ৮২ জন। ইংরেজ, ফরাসি, ডাচ ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মূলধনের শতকরা ৭৩ ভাগ নীলের কারবারে লগ্নিকৃত ছিল। সে সময় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অন্য কোন পণ্য নীলের মত এত ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে নি। [১১]


নীল কুঠি ও কারবার পরিচালনা

তৎকালীন সময়ে কোম্পানি একাধিক কুঠি স্থাপন করে ব্যবসা চালাত। তার মাঝে একটি কুঠিতে সমগ্র কারবার পরিচালনা করার জন্য একটি পরিচালনা পর্ষদ থাকত, যেটি সদর কুঠি বা কনসার্ন নামে পরিচিত ছিল। সদর কুঠিতে পরিচালনা পর্ষদ প্রতি কুঠিতে একজন ব্যবস্থাপক বা অধ্যক্ষ নিয়োগ করত। তাকে বড় সাহেব এবং তার সহকারিকে ছোট সাহেব বলে সম্ভোধন করা হত। এই পদ দুইটি সবসময় ইংরেজ শ্বেতাঙ্গদের জন্য নির্দিষ্ট ছিল। বাকি পদগুলোতে দেশীয়রা চাকরি করতো। ছোট সাহেবের পর যার সর্বোচ্চ পদমর্যাদা ছিল, তাকে বলা হত দেওয়ান বা নায়েব। অনেক ক্ষেত্রে এই পদটিও একজন ইংরেজ বা শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তি দখল করত। দেওয়ানের আবার একাধিক সহযোগী থাকত। এসব সহযোগী প্রজা ও অন্যান্য নিম্নপদস্থ কর্মচারীর সাথে সাহেবদের যোগাযোগ রক্ষা করত। তাদের প্রধান কাজ ছিল হিসাবপত্রের নানা কাজ করা। দেশীয় কর্মচারীদের মাঝে এরাই সর্বাপেক্ষা লাভবান হত। কারণ হিসাবে গরমিল, সই জালকরণ, ঘুষ গ্রহণ ও সুদের কারবারি করে এরা প্রজাদের কাছ থেকে প্রভূত অর্থোপার্জন করত।[১২]


এরপর ছিল পর্যায়ক্রমে গোমস্তা, মুৎসুদ্দি, মেঠো আমিন, সদর আমিন, সরকার, তহসিলদার, মাহুত, সহিস, বরকন্দাজ, ওজনদার, পেয়াদা, জমাদার, তাগিদগীর, চৌকিদার, মালি প্রভৃতি অসংখ্য নিম্নপদের কর্মচারী। এমনকি যারা পানি, জ্বালানি, দুধ, দৈ, মুরগি, মাংস, ডিম সরবরাহ করত বা সাহেবের ছাগল-ভেড়া চরাত, তারাও ছিল তকমাধারী।



উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলায় মঙ্গলগঞ্জ নীলকুঠি

বেতনের ক্ষেত্রে, দেশি দেওয়ানের বেতন ছিল মাসে ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। ১৭ টাকা পেত গোমস্তা। আমিনের কাজ ছিল জমির সীমানা বের করা ও মাপজোক করা। সে বেতন পেত ১৪ টাকা। সরকার ও তহসিলদারের বেতন ছিল ১১ টাকা। মাহুত ও সহিস পেত ৭ টাকা। বাকি কর্মচারীরা কোন বেতন পেত না, তবু তারা চাকরি করত এবং এলাকায় নিম্ন আয়ের লোকদের মাঝে তারাই ছিল অবস্থাসম্পন্ন। কারণ তারা সাধারণ মানুষকে ভীষণভাবে শোষণ করত। নীল পরিমাপের জন্য ওজনদার এবং রায়তদের কাজে তাগিদ দেবার জন্য তাগিদগীর ছিল। তাগিদগীর যথাসময়ে নীলবীজ ও দাদন গ্রহণের জন্য কৃষক প্রজাদের সংবাদ পৌঁছে দিত এবং বৃষ্টির পর কোন জমিতে নীল বুনতে হবে, তা জমিতে 'দাগ' মেরে নির্দিষ্ট করে দিত। [ক] পেয়াদা পুলিশের কাজ করত। কাউকে ধরে আনা এবং শাস্তি প্রদান করা তার কাজ ছিল। সম্ভবত গোমস্তার পর পেয়াদাই সবচেয়ে জুলুমবাজ কর্মচারী ছিল। কুলি ও মজুরদের কাজ দেখাশোনা করত জমাদার। সহরত ও ইস্তেহার ইত্যাদি জারি করত চৌকিদার। বরকন্দাজ ছিল কুঠির লাঠিয়াল বাহিনীর প্রধান। এরা সবাই সাধারণ মানুষের কাছে ভীষণভাবে ঘৃণ্য ছিল। [১৩] এসব কর্মচারীর অধিকাংশই মুসলিম সমাজ থেকে আগত ছিল, যদিও তুলনামূলক উচ্চ পদগুলো ছিল হিন্দুদের দখলে।

নীলচাষের প্রাথমিক অসুবিধা ও প্রতিকার

লর্ড কর্নওয়ালিস চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে বহু হিন্দু সরকারি কর্মচারীকে এদেশের জমির মালিক করে দেন। এরা নিজ জমিদারি সীমার মাঝে ছোটখাটো রাজা-বাদশার মত ক্ষমতা ভোগ করত। এরা জমি তো বটেই, প্রজার জানমাল, এমনকি তাদের ইজ্জত-সম্ভ্রমের মালিকও ছিল। ইংরেজরা এদেশে এসে এই ভূস্বামী শ্রেণীটিকে তাদের সামনে সবচেয়ে বড় বাধা হিসাবে দেখতে পেল। কারণ, তারা যদি জমি কিনেও নিত, তবুও প্রজারা ওই ভূস্বামীদের অধীনে থাকত। ফলে জমিদারের অধীন প্রজাকে দিয়ে নীলকররা ইচ্ছেমত কাজ করিয়ে নিতে পারত না।


এই সমস্যা সমাধানের জন্য ব্রিটিশ রাজপ্রতিনিধিগণ প্রভাব বিস্তার করে ১৮১৯ সালে অষ্টম আইন (Eight regulation of 1819) বলবৎ করেন। এই আইনে জমিদার নিজের ভূমির ভেতর 'পত্তনি তালুক' দেবার সুযোগ পায় এবং কিছু দিনের মাঝেই জমিদাররা অধিক মুনাফার আশায়, আবার কোথাও অত্যাচার বা জুলুমের ভয়ে নীলকরদের কাছে বড় বড় পত্তনি দিতে শুরু করে। কিন্তু তবুও ইংরেজদের সমস্যার সম্পূর্ণ সমাধান হয় নি। কারণ পত্তনি ব্যবস্থায় জমিদারকে উচ্চহারে সেলামি ও খাজনা দিতে হত, বিনিময়ে পাঁচ বছরের জন্য জমিস্বত্ব এবং দৈনিক মজুরির বিনিময়ে প্রজার সেবা পাওয়া যেত, যা ছিল অত্যন্ত খরচসাধ্য। তাই খরচ কমাতে নীলকরদের বাঁকুড়া, বীরভূম, সিংভূম, ধানভূম, মানভূম প্রভৃতি দূরবর্তী এলাকা থেকে শ্রমিক এনে কাজ করাতে হত। তাই এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে কুঠিয়ালরা জমিদারি হস্তগত করার চেষ্টা করতে থাকে। তাদের সর্বতোভাবে সাহায্য করেন মুৎসুদ্দি ও চাকুরেগণ। এদের মাঝে প্রসন্নকুমার ঘোষণা করেন,


আলস্য, অনভিজ্ঞতা ও ঋণের জন্য দেশীয় জমিদারগন জমি পত্তনি দিতে উদগ্রীব হন, কারণ ইহাতে তাহারা জমিদারি চালাইবার ভার হইতে নিষ্কৃতি লাভ করেন এবং জমি পত্তনিদানের মত একটি নিশ্চিত আয়ের সাহায্যে রাজধানী কিংবা কোন একটা বড় শহরে বাস করিতে পারেন। এবং ইহাই রায়তদের জন্যে কল্যাণকর। [১৪]


এভাবে ভেতরে বাইরে চেষ্টার ফলে ১৮৩৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়ার সনদে চতুর্থ আইনের (Fourth regulation of 1833) দ্বারা বাংলাদেশে ইংরেজদের জমি ও জমিদারি ক্রয়ের সুযোগ প্রদান করা হয়। অনেক জমিদার অধিক মূল্য পেয়ে, কেউবা দুর্ধর্ষ নীলকর বা ম্যাজিস্ট্রেটের হুমকি পেয়ে জমিদারি বিক্রি করে চলে যায়। যারা এর আগে পত্তনি বন্দোবস্ত দিয়েছিল, তারা আর কখনো তালুক বা জমিদারি ফেরত পায়নি। অনেক জমিদার পাশের জমিদারের সাথে শত্রুতা করে জব্দ করার জন্য নীলকরদের ডেকে আনত। কিন্তু পরবর্তীতে নীলকররা উভয়ের জমিই গ্রাস করে নিত। এভাবে বাংলার সর্ববৃহৎ নীল ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান 'বেঙ্গল ইন্ডিগো কোম্পানি' কেবল চুয়াডাঙ্গা, ঝিনেদা, রানাঘাট ও যশোর থেকেই ৫৯৪টি গ্রামের জমিদারি ক্রয় করে। এই বিশাল জমিদারি থেকে তারা ব্রিটিশ সরকারকে রাজস্ব দিত মাত্র ৩ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা, যেখানে কেবল চুয়াডাঙ্গা ও রানাঘাট এলাকায় এরা ১৮ লক্ষ মূলধন খাটাত। মূলত এই ভাবে ইংরেজগণ অধিকাংশ জমিদারি ক্রয় করে বাংলায় জেঁকে বসে ও নীল চাষ শুরু করে। [১৫]


বিদ্রোহ কারণসমূহ

১৭৭৭ সালে বাংলায় প্রথম নীল চাষ শুরু হয় এবং লুইস বোনার্ডকে প্রথম নীলকর মনে করা হয়। উনিশ শতকের প্রথম ভাগে ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লবের ফলে সেখানকার বস্ত্র-শিল্পে নীলের চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়ে গিয়েছি। বাংলায় ব্রিটিশ ক্ষমটা সম্প্রসারণের সাথে সাথে নীল চাষের এলাকা বর্ধমান, বাঁকুড়া, বীরভূম, মুর্শিদাবাদ এলাকায় বিস্তৃত করে। নীলকররা কৃষকদের উৎকৃষ্ট জমিতে নীল বুনতে বাধ্য করত। নীল ছাড়া অন্য কোনো শস্য উৎপাদন করতে দিত না। দাদনের টাকা নেওয়ার সময় শর্তসাপেক্ষে চুক্তিপত্রে টিপ সই দিতে হতো আর চুক্তি অনুযায়ী কাজ না করলে চাষির ওপর চালানো হতো অকথ্য অত্যাচার। ১৮৩০ খ্রিষ্টাব্দে সরকার এক আইন জারি করেছিল যাতে নীলকররা আরও শক্তিশালী ও আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। নীল চাষ করতে না চাইলে কৃষকদের ওপর বিভিন্নভাবে নির্যাতন চালানো হতো। যেসব কৃষক অত্যাচারের ভয়ে বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতেন, তাদের ভিটেমাটিতে নীল চাষ করা হত। কারও কারও গৃহ-বাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হত। প্রতিটি নীলকুঠিতে ছিল কয়েদখানা। অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় নীল চাষের বিরুদ্ধে চাষীরা ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করে এবং চারদিকে বিদ্রোহের সুত্রপাত ঘটে।[১৬] মধ্যবিত্ত সমাজ কৃষকদের আকুন্ঠ সমর্থন দিয়েছিল। হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায়, তার সংবাদপত্র দি হিন্দু প্যাট্রিয়ট-এ গরিব কৃষকদের দুর্দশার কথা তুলে ধরেন। এরপর, দীনবন্ধু মিত্র নিবন্ধ পাঠ করেন এবং নীল দর্পণ নাটকের মাধ্যমে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তুলে ধরেন। নাটকটি ব্যাপক বিতর্কের সৃষ্টি করে।

বিদ্রোহ

তৎকালীন নদীয়া, বর্তমানে বাংলাদেশের যশোর জেলায় চৌগাছায় সর্বপ্রথম বিদ্রোহ দেখা দেয় বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাসের নেতৃত্বে। [১৬] বিদ্রোহ দ্রুত বর্ধমান, বাঁকুড়া, বীরভূম মুর্শিদাবাদ পাবনা ও খুলনায় ছড়িয়ে পড়ে। কিছু নীলকরের বিচার করা হয় এবং ফাঁসি দেয়া হয়। কৃষকরা বহু নীলকুঠি ভেঙে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেয়। নীলকরদের মাল বহনের যোগাযোগের রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। সশস্ত্র কৃষকরা সরকারি অফিস, থানা, স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেটের কাছারি প্রভৃতির ওপর আক্রমণ চালায়। এই বিদ্রোহে হিন্দু-মুসলমান কৃষকরা ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধভাবে যোগ দিয়েছিল। নীল বিদ্রোহ কঠোরভাবে দমন করা হয়। ব্রিটিশ সরকারের ও কিছু জমিদারের সমর্থন নিয়ে পুলিশ এবং সামরিক বাহিনীর দিয়ে কিছু কৃষকের উপর অত্যাচার করা হয়। যদিও এই বিদ্রোহ ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়, যাতে প্রায় সমগ্র বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। নদীয়ার দিগম্বর ও বিষ্ণুচরন বিশ্বাস, পাবনার কাদের মোল্লা, মালদার রফিক মণ্ডল জনপ্রিয় নেতা ছিলেন। বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে নীলকরদের ত্রাসের কারন ছিলেন আরেক বিদ্রোহী বিশ্বনাথ সর্দার। তিনি একাধিক নীলকুঠি আক্রমন করেছিলেন। নদীয়ার আসাননগরের কাছে তার ফাঁসি হয়। ঐতিহাসিক সুপ্রকাশ রায় বিশ্বনাথ সর্দারকে নীলবিদ্রোহের প্রথম শহীদ রূপে গন্য করেছেন। যদিও ইংরেজরা নীলবিদ্রোহী বিশ্বনাথকে বিশে ডাকাত হিসেবে চিত্রায়িত করে।[২][১৭]

ভারতে ব্রিটিশ শাসকদের উপর প্রভাব

ঐতিহাসিক যোগেশচন্দ্র বাগল এর বর্ণনা মতে কৃষকদের নীল বিদ্রোহের অহিংস আন্দোলন, সিপাহী বিদ্রোহের চেয়ে বেশী সফল হয়। বিদ্রোহের ঘটনার খবর ইংল্যান্ডে পৌঁছে যায়। এবং এটি নিয়ে পার্লামেন্টে প্রকাশিত হওয়ার দরুন চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট কৃষকদের দুরবস্থার বিষয় নিয়ে ইংরেজ শাসকদের কাছে কৈফিয়ত তলব করে এবং বিদ্রোহ ও অসন্তোষের কারণ অনুসন্ধানে একটি কমিটি গঠন করে। কমিটি সবকিছু তদন্ত করে নীল গাছের দাম বাড়িয়ে দেয় আর এতে লাভের পরিমাণ কমে গেলে নীলকররা কারখানাগুলো বিক্রয় করতে বাধ্য হয়। ১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দে নীলের উৎপাদন কমে যাওয়ায় নীলকররা এই ব্যবসা বন্ধ করে দেয়।[১৬]

সাংস্কৃতিক প্রভাব

দীনবন্ধু মিত্র ১৮৫৯ সালে নীল বিদ্রোহ নিয়ে নীল দর্পণ নাটক রচনা করেন। মাইকেল মধুসূদন দত্ত এটি ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করেন এবং এটি প্রকাশ করেন রেভারেন্ড জেমস লং। এটা ইংল্যান্ডে অনেক মনোযোগ আকৃষ্ট করে, যেখানে তাদের দেশের মানুষের বর্বরতার তারা স্তব্ধ হয়ে যায়। কিন্তু এদেশে ব্রিটিশ সরকার পরিহাসমূলক বিচারের মাধ্যমে রেভারেন্ড লং- কে কারাদন্ড ও জরিমানার শাস্তি দেয়া হয়। কালীপ্রসন্ন সিংহ তার জরিমানার টাকা পরিশোধ করেন।


Post a Comment

0 Comments
* Please Don't Spam Here. All the Comments are Reviewed by Admin.